‘জেলা চট্টগ্রাম বার আউলিয়ার শহর’ অলি সুফি পীর সাধকের পদধূলি ধন্য চট্টগ্রাম জেলা। সূফিকামেল দের শহর চট্টগ্রাম। সাহাবেয়ে রাসুল এর আগমনে ধন্য চট্টগ্রাম।
বাংলার পবিত্র ভূমিকে আধ্যাত্মিকতার বাগানে রূপান্তর করেছেন যে সকল পীর-আউলিয়া ও সুফি দরবেশ, তাঁদের মধ্য অন্যতম একজন হলেন হযরত কালু শাহ (রহ.)। সুদূর ইয়ামেন থেকে যাত্রা করে তিনি এসেছিলেন বাংলার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে এবং মানবতার কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিতে। তাঁর সহজ-সরল জীবনধারা, আধ্যাত্মিক সাধনা এবং মরমী দৃষ্টিভঙ্গি এ জনপদের মানুষকে ইসলামের শান্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের দিকে আকৃষ্ট করে।
ঐতিহাসিক দলিল ও স্থানীয় লোককথা অনুযায়ী, হযরত কালু শাহ (রহ.) ছিলেন আরব দেশের ইয়ামেন অঞ্চলের অধিবাসী। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি সমুদ্রপথে চট্টগ্রামের উপকূলীয় সলিমপুর এলাকায় এসে অবস্থান গ্রহণ করেন। ধারণা করা হয় তিনি হিজরি ৬৩৩ সন, ইংরেজি ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে এদেশে আগমন করেন। চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালতের সংরক্ষণাগারে থাকা প্রাচীন জরিপ রিপোর্টে উল্লেখ আছে যে, ১২০০ মগী সনের জরিপে তাঁর মাজার শরীফের ভূমি হযরত কালু শাহ (রহ.)-এর জিম্মায় ছিল। এসব ইতিহাস থেকে জানা যায় তিনি এদেশীয় নন, বরং প্রবাসী একজন সাধক ছিলেন যিনি চট্টগ্রামকেই আত্মার ঠিকানা বানিয়েছিলেন।
সুফিবাদ হচ্ছে আত্মশুদ্ধির এক অনুপম পথ, যা প্রেম, সহানুভূতি ও ঈশ্বরভক্তিকে কেন্দ্র করে বিকাশ লাভ করে। হযরত খাজা কালু শাহ (রহ.)-এর জীবন ছিল এই সুফি ভাবধারারই এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। তিনি লোকালয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও বাহ্যিক জৌলুশ বা ক্ষমতার পেছনে ছুটেননি। বরং নীরবে, নিভৃতে মানুষের অন্তরে ইসলামের শান্তির বাণী প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনার ফলে অগণিত মানুষ দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সীতাকুণ্ডের কালু শাহ নগর তাঁর স্মৃতির স্মারক হয়ে আজও মানুষকে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চেতনার দিকে আহ্বান জানায়।
ইসলামী দাওয়াত ও সমাজ বিনির্মাণে অবদান: ইসলামের মূলনীতি— তাওহিদ, ন্যায়, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও মানবিকতা— তিনি নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করে সমাজে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেন। স্থানীয় মানুষ তাঁর চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের অন্তরকে আলোকিত না করে বাহ্যিক ধর্মীয় আচরণ যথেষ্ট নয়। তাঁর আধ্যাত্মিকতার আদর্শে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা, মসজিদ, এতিমখানা এবং দাতব্য চিকিৎসালয় প্রমাণ করে যে তিনি শুধু ধর্ম প্রচারেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং সমাজের দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোতেও ছিলেন অগ্রণী। তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত: হযরত খাজা কালুশাহ (রহ.) সুন্নিয়া আলিম মাদরাসা, হযরত খাজা কালু শাহ (রহঃ) বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, হযরত খাজা কালু শাহ (রহঃ) জামে মসজিদ, হেফজখানা ও এতিমখানা, দাতব্য চিকিৎসালয় ; এসব প্রতিষ্ঠান আজও তাঁর কর্মের ধারক ও বাহক হিসেবে সমাজে আলো ছড়িয়ে চলেছে।
হযরত কালু শাহ (রহ.) ছিলেন মরমী দর্শনের এক জীবন্ত প্রতীক। তাঁর জীবন ও শিক্ষায় সুফিবাদের সারকথা ছিল— আল্লাহর প্রেম, মানবতার সেবা ও আত্মিক পরিশুদ্ধি। তিনি বিশ্বাস করতেন, অন্তরের আলোকেই মানুষ আল্লাহর নিকটবর্তী হয়। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. আবদুল করিম তাঁর “চট্টগ্রামের ইসলাম” গ্রন্থে যে চল্লিশজন আবদালের তালিকা দিয়েছেন, সেখানে “কালুমিয়া” নামে এক অলির উল্লেখ রয়েছে, যিনি অনেকের মতে হযরত কালুশাহ (রহ.)-ই হতে পারেন। বিভিন্ন ইতিহাস রচয়িতার মতে, হযরত কালু শাহ (রহ.) ছিলেন হযরত বদর আউলিয়ার সফরসঙ্গী। বদর আউলিয়াকে চট্টগ্রামের প্রাচীন মুসলিম মিশনারী হিসেবে ধরা হয়। তাঁদের নেতৃত্বে ও দাওয়াতের মাধ্যমে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইসলামের শেকড় বিস্তার লাভ করে।
চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারের ইতিহাসের সূচনা হয় রাসূলুল্লাহ (দঃ)-এর সাহাবী হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাঃ)-এর আগমন দিয়ে। এরপর একে একে বহু পীর-আউলিয়ার আগমন ঘটে। এই ধারাবাহিকতাতেই হযরত কালু শাহ (রহ.)-এর আগমন ঘটে এবং তিনিও হয়ে ওঠেন এক প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক পুরুষ।
চট্টগ্রামের একজন মহান দার্শনিক ও ইসলামি চিন্তাবিদ ইমাম সৈয়দ আজিজুল হক শেরে বাংলা (রহ.) তাঁর ফারসি ভাষায় রচিত “দিওয়ান-ই-আজিজ” গ্রন্থে হযরত কালু শাহ (রহ.)-এর জীবনমান ও কর্মের প্রশংসা করেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, তিনি শুধুমাত্র সাধারণ জনমানুষের প্রিয় ছিলেন না, বরং জ্ঞানী ও সূফি মহলেও তিনি ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র।
বর্তমানে সীতাকুণ্ড উপজেলার সলিমপুর এলাকায় অবস্থিত হযরত কালু শাহ (রহ.)-এর মাজার শরীফ শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় তীর্থস্থান নয়, বরং এটি একজন মহান অলির আত্মিক শক্তির নিদর্শনস্বরূপ।
ইতিহাসে হযরত কালু শাহ ( রাহ:) এই নামে থাকলেও স্থানীয় জনমানব ও লোকমহল “হযরত খাজা কালুশাহ (রহ.)” নামে ডাকেন ও লিখেন।
“হযরত খাজা কালুশাহ ( লরহ:) মাজার কমপ্লেক্স” নামে একটি স্বীকৃত পরিচালনা কমিটি আছে যার ইসি নম্বর ১৭৭৪৩। এই কমিটি তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে ও মাজার সংলগ্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পরিচালনা করে।
প্রতি বছর ৮ই মহররম পালিত হয় তাঁর বার্ষিক ওরশ শরীফ। ২০২৫ সালের ওরশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে ৪ জুলাই (২০ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ)। এই দিনে দেশ-বিদেশের হাজারো ভক্ত-আশেক মাজারে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
হযরত খাজা কালু শাহ (রহ.) ছিলেন ইসলামি মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিকতার এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়, সত্যিকারের ধর্মচর্চা মানে শুধু বিধান পালন নয়, বরং মানবতার সেবা, আত্মশুদ্ধি ও সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। চট্টগ্রামের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে তিনি একটি অমলিন অধ্যায়, যেখান থেকে আজও মানুষ সত্যের আলো গ্রহণ করছে। তাঁর ওরশ শরীফ শুধু একটি অনুষ্ঠান নয়, এটি এক আত্মিক মিলনমেলা, যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—সত্যিকারের আধ্যাত্মিকতা কখনো মরে না, বরং যুগ থেকে যুগান্তরে পথ দেখিয়ে যায়।
সূত্র / ঋনস্বীকার: আল্লামা গাজী সৈয়দ মুহাম্মদ আজিজুল হক শেরে বাংলা (রহ:), ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. আবদুল করিম, অনুবাদক মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, মনওয়ার সাগর, ইমামে আহলে সুন্নত আল্লামা কাজী নুরুল ইসলাম হাশেমী (রহ:), আল্লামা মুফতি ওবায়দুল হক নঈমী (রহ:), ইতিহাসবিশারদ আজিজুল হক (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত), ইতিহাসবিদ আহমদ মমতাজ (রহ:), ড. শেখ আহমদ আলী (রহ:) (ভারত), জিএম মামুনুর রশিদ, মাওলানা ওবাইদুল হক (রহ:), আলহাজ্ব মাওলানা ওবাইদুল হক (রহ:), পূঁথিগবেষক মোহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী (রহ:)।
লেখক : সোহেল মো. ফখরুদ-দীন, সভাপতি, মুসলিম হিস্ট্রি এসোসিয়েশন বাংলাদেশ, সভাপতি, চট্টগ্রাম, ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র ( সিএইচআরসি) , বাংলাদেশ। তারিখ : ৪ জুলাই ২০২৫ ইং ।
খালেদ / পোস্টকার্ড ;