দেশের প্রথম মনোরেল নির্মাণে রোববার (১ জুন) চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) এবং জার্মান-মিশরের যৌথ উদ্যোগে গঠিত ওরাসকম গ্রুপ ও আরব কন্ট্রাক্টর গ্রুপের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি (MoU) স্বাক্ষরিত হয়েছে।
দুপুরে নগরীর আগ্রাবাদের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে এই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পক্ষে মেয়র ডা. শাহাদাৎ হোসেন এবং অর্থায়নকারী দুই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা এতে স্বাক্ষর করেন।
যানজট নিরসনের পাশাপাশি নিরাপদ ও আরামদায়ক পরিবহন হিসেবে আগামী সাড়ে তিন থেকে চার বছরের মধ্যে নগরে চালু হতে পারে মনোরেল। তিনটি রুটে প্রস্তাবিত এই মনোরেলের দৈর্ঘ্য হবে সাড়ে ৫৪ কিলোমিটার। মনোরেল নির্মাণ প্রকল্পে সম্ভাব্য ব্যয় হতে পারে ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) মনোরেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। তবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বিদেশি দুই প্রতিষ্ঠান আরব কন্ট্রাক্টরস ও ওরাসকম পেনিনসুলা কনসোর্টিয়াম। সরকারি–বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) প্রকল্পের আওতায় মনোরেল নির্মাণ প্রকল্পটিতে বিনিয়োগ করা হবে এনএএস ইনভেস্টমেন্ট ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব ইজিপ্টের মাধ্যমে।
রোববার দুপুরে মনোরেল নির্মাণে নগরের আগ্রাবাদে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার মিলনায়তনে চসিক এবং আরব কন্ট্রাক্টরস ও ওরাসকম পেনিনসুলা কনসোর্টিয়ামের মধ্যে এই সমঝোতা স্মারক চুক্তি (এমওইউ) হয়েছে। চসিকের পক্ষে মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে আরব কন্ট্রাক্টরস ও ওরাসকম পেনিনসুলা কনসোর্টিয়ামের চিফ রিপ্রেজেন্টেটিভ কাউসার আলম চৌধুরী স্বাক্ষর করেন। বক্তব্য রাখেন অনুষ্ঠানের আয়োজক গ্রেটার চিটাগাং ইকোনমিক ফোরামের প্রেসিডেন্ট আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী।
শুধু যানজট নিরসনে নয়, চট্টগ্রামকে একটি পরিবেশবান্ধব পর্যটন নগরে রূপান্তর করবে : সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আমি চেষ্টা করছিলাম কীভাবে শহরটাকে আরো সুন্দর করা যায়, প্ল্যানড সিটি করা করা যায় এবং কীভাবে ট্রাফিক সিস্টেমটাকে আমরা রিডিউস করতে পারি। এজন্য ট্রাফিক বিভাগের সাথে কিছু কাজ হাতে নিই, তাদের সাথে সমন্বয় বৃদ্ধি করেছি এবং স্মার্ট ট্রাফিক সিস্টেম দ্রুততম সময়ে শুরু করব। সাগরিকা এবং বাকলিয়ায় বাস টার্মিনাল করার পরিকল্পনা আছে। কূলগাঁওয়ে কাজ চলছে। সিডিএ থেকে কর্পোরেশনের অধীনে এনে বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালকে আধুনিক করার চেষ্টা করছি। সামগ্রিকভাবে ট্রাফিক সিস্টেমকে কীভাবে শৃঙ্খলায় আনা যায় তার চেষ্টা করছি। মনোরেল এই সমস্যাগুলোর সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এই মনোরেলের বড় একটা সুবিধা হচ্ছে এটা দক্ষিণ এশিয়ার একটা গেটওয়ে হিসেবে কাজ করবে। এটা অত্যন্তু গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, এই মনোরেল শুধু যানজট নিরসনে নয়, বরং চট্টগ্রামকে একটি পরিবেশবান্ধব, পর্যটন ও ব্যবসাবান্ধব নগরীতে রূপান্তর করার দিকেও এগিয়ে নেবে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে সংযোগের একটি আধুনিক সেতুবন্ধন তৈরি করবে।
মেয়র বলেন, মনোরেল নির্মাণে বাংলাদেশি টাকায় ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। আরব কন্ট্রাক্টরস ও ওরাসকম পেনিনসুলা কনসোর্টিয়াম এই ইনভেস্টটা নিয়ে আসবে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কোনো ইনভেস্টমেন্ট নেই। শুধুমাত্র যে লজিস্টিক সাপোর্টগুলো আছে, বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশনের যে জায়গার উপর দিয়ে এই মনোরেল যাবে সেটা আমাদেরকে কনসেন্ট করে দিতে হবে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের যে অনুমতি সেটা আমাদের নিয়ে দিতে হবে। অন্যান্য যে লজিস্টিক সাপোর্ট সেটাও সিটি কর্পোরেশন করবে।
শাহাদাত বলেন, আমরা এক সময় মিয়ানমার থেকে একটা রুটের কথা বলেছি। এখন আরো বেশি স্বপ্ন দেখতে চাই চট্টগ্রাম নিয়ে। আমরা শহরকে ওয়ান সিটি টু টাউন হিসেবে পর্যটন সিটি করতে চাই; আমাদের এই চিন্তাগুলোকে ত্বরান্বিত করবে মনোরেল। পর্যটন নগরী হিসেবে চট্টগ্রামের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে চাই। এই মনোরেল প্রকল্প তা বাস্তবায়নের পথে আমাদের অনেক এগিয়ে দেবে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক করতে হবে। যদি পুরো এরিয়াকে সারাউন্ডিং কর্ণফুলী রিভার নিয়ে যদি আমরা পর্যটন শহর চিন্তা করি তাহলে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক করা সময়ের দাবি। এ বিষয়ে সবাইকে কথা বলতে হবে। তিনি বলেন, অনেক সময় বাজেট থাকে না। কিন্তু আমরা চেষ্টা করছি। মিনিস্ট্রিতে গিয়ে কথাবার্তা বলে ওখান থেকে কিছু বাজেট এনে আমরা চট্টগ্রামের মানুষের জন্য কাজ করার চিন্তা করছি।
গ্রেটার চিটাগাং ইকোনমিক ফোরামের প্রেসিডেন্ট আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী বলেন, মনোরেল হবে অক্সিজেন থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত। তারপরও যদি প্রয়োজন মনে করে এটার পরিধি আরো বাড়তে পারে। ওরাসকম কোম্পানি ও আরব কন্ট্রাক্টর কোম্পানি এটা করবে। ওরাসকম হচ্ছে জার্মান ও মিশরের জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি এবং আরব কন্ট্রাক্টর হলো মিশরের আরেকটি কোম্পানি। এই ধরনের (মনোরেল নির্মাণ) কাজে পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত রয়েছে তাদের কার্যক্রম। ওরাসকম ও আরব কন্ট্রাক্টর মিলে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ মনোরেল কায়রো শহরে করছে, যার দৈর্ঘ্য ৯৬ কিলোমিটার।
তিনি বলেন, এমওইউ হওয়ায় সিটি কর্পোরেশন সরকারি যে ফর্মালিটিস আছে সেগুলো করবে। ওরাসকম ও আরব কন্ট্রাক্টর ফিজিবিলিটি স্টাডি করার পর মূল কার্যক্রম শুরু করবে। এটার জন্য ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বাজেট আছে। পুরো কাজটা সম্পন্ন করতে সম্ভবত তিন থেকে চার বছর লাগতে পারে। কাজটা হয়ে গেলে নগরবাসীর জন্য একটা মানসম্মত ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা হবে।
আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমরা চট্টগ্রামকে একটি সমন্বিত স্মার্ট, পরিবেশবান্ধব, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন; যেটাকে গেটওয়ে টু এশিয়া বলি সেটা করার স্বপ্ন দেখছি। আমাদের সাথে সিটি কর্পোরেশন আছে। চট্টগ্রামের সর্বস্তরের জনগণকে নিয়ে আমরা এই কাজটা করতে চাই। আশা করি, ভবিষ্যতে আরো কিছু প্রকল্প এখানে আনতে পারব।
আরব কন্ট্রাক্টরস ও ওরাসকম পেনিনসুলা কনসোর্টিয়ামের চিফ রিপ্রেজেন্টেটিভ কাউসার আলম চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। এখানে যানজট ও পরিবহন সংকট ক্রমবর্ধমান। মনোরেল একটি আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব সমাধান। আমরা এই প্রকল্পে পূর্ণাঙ্গ বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
চুক্তি স্বাক্ষর শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, মনোরেল নির্মাণের জন্য প্রাথমিকভাবে সমঝোতা স্মারক চুক্তি হয়েছে। এখন সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করব। এই কাজ করতে অন্তত নয় মাস থেকে এক বছর সময় লাগবে। এরপর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
মনোরেল চলবে তিন রুটে : আরব কন্ট্রাক্টরস ও ওরাসকম পেনিনসুলা কনসোর্টিয়ামের প্রতিনিধি কাউসার আলম চৌধুরী সম্ভাব্য মনোরেল নিয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনা তুলে ধরেন। তিনি জানান, মনোরেলের সম্ভাব্য রুট তিনটি। এর মধ্যে এক নম্বর লাইনের দৈর্ঘ্য সাড়ে ২৬ কিলোমিটার। এটি কালুরঘাট থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত (বহদ্দারহাট, চকবাজার, লালখান বাজার, দেওয়ানহাট ও পতেঙ্গা হয়ে) যাবে।
মনোরেলের দ্বিতীয় লাইনটি যাবে সিটি গেট থেকে শহীদ বশিরুজ্জামান স্কয়ার (এ কে খান, নিমতলী, সদরঘাট ও ফিরিঙ্গিবাজার হয়ে) পর্যন্ত যাবে। এটির দৈর্ঘ্য সাড়ে ১৩ কিলোমিটার। মনোরেলের তৃতীয় লাইনটি যাবে অক্সিজেন থেকে ফিরিঙ্গিবাজার (মুরাদপুর, পাঁচলাইশ, আন্দরকিল্লা ও কোতোয়ালী হয়ে) পর্যন্ত। এটির দৈর্ঘ্য সাড়ে ১৪ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে ৫৪ কিলোমিটার রুটে চলবে মনোরেল। রুটগুলোতে প্রতি ঘণ্টায় কয়েক হাজার মানুষকে নিরাপদে এবং আরামদায়কভাবে পরিবহনে সক্ষম হবে মনোরেল। মনোরেল চলবে বিদ্যুতের সাহায্যে। এতে দূষণ কমবে শহরের। আবার মূল সড়ক ব্যবহার না করায় কমবে যানজট। মুরাদপুর, জিইসি, বহদ্দারহাট এবং দেওয়ানহাটের মতো ব্যস্ততম এলাকায় যানজটের চাপ কমাবে। পাশাপাশি যাত্রীদের ভ্রমণ অর্ধেকেরও বেশি কমিয়ে আনবে মনোরেল।
কাউসার আলম চৌধুরী মনে করেন, মনোরেল থেকে রাজস্ব আসবে শুধু টিকিট নয়, বরং বিজ্ঞাপন, স্টেশনে দোকানপাট, আশপাশের সম্পত্তিমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমেও। একটি ভালো গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে ৫৭ গুণ পর্যন্ত অর্থনৈতিক রিটার্ন পাওয়া যায়। তিনি বলেন, মনোরেল কেবল আকাশে উড়ন্ত ট্রেন নয়, এটি ভবিষ্যতের সেতু। এটি শহরে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখা প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি উপহার।
সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন গ্রেটার চিটাগাং ইকোনমিক ফোরামের সদস্য সচিব এম এ এন শাহীন, দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক, দৈনিক পূর্বকোণের সম্পাদক ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী, দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেক, চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রাক্তন পরিচালক নাসির উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, এস এম আবু তৈয়ব, নাসির উদ্দিন চৌধুরী, অশিত কুমার শাহা, স্থপতি এম সাদী, বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাইফউদ্দিন মোহাম্মদ তারেক, পেনিনসুলা কনসোর্টিয়ামের সহযোগী পরিচালক মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) এম নাসিম, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের সহসভাপতি এ এম মাহবুব চৌধুরী, মো. আবদুল মান্নান, চসিকের প্রধান নির্বাহী শেখ মো. তৌহিদুল ইসলাম, প্রধান প্রকৌশলী মো. আনিসুর রহমান, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা এস এম সরওয়ার কামাল, খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আব্দুস সালাম, স্থপতি আশিক ইমরান, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ প্রমুখ।
খালেদ/ পোস্টকার্ড ;