Dhaka ০২:০১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ, ভোটে অংশ নিতে লাগবে নিবন্ধন

  • ঢাকা অফিস।।
  • আপডেটের সময় : ০৪:২২:০৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১ মার্চ ২০২৫
  • ৪০ টাইম ভিউ

জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের অংশগ্রহণে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি-এনসিপি) আত্মপ্রকাশ করেছে। তরুণদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের ঘোষণা দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি)। জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে নতুন এই রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ হয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বিশাল এক জনসভার মধ্য দিয়ে এ নতুন দলের আত্মপ্রকাশ হয়। জুলাই শহীদ মো. ইসমাইল হোসেন রাব্বির বোন মিম আক্তার জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে তিনি দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব আখতার হোসেনের নাম ঘোষণা করেন। পরে আংশিক কমিটির অন্যান্য সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন আখতার হোসেন।

সকাল থেকেই স্লোগানে স্লোগানে মিছিল নিয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জড়ো হন বিপুলসংখ্যক ছাত্র–জনতা। নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘিরে পতাকা হাতে নিয়ে, মাথায় পতাকা বেঁধে মিছিল নিয়ে তাদেরকে উচ্ছ্বাস করতে দেখা গেছে। বিকেল সাড়ে ৪টায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তারেক রেজার কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে সমাবেশের মূল পর্ব শুরু হয়। এরপর অন্যান্য ধর্মগ্রন্থসমূহ পাঠ এবং জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়। তারপর জুলাই–আগস্ট অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন এবং জুলাই অভ্যুত্থানের ওপর নির্মিত ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়েছে। পরে বক্তব্য রাখেন জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতৃবৃন্দ। অনুষ্ঠানে বিএনপি–জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা আকবর খান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের জেনারেল সেক্রেটারি মাওলানা জালাল উদ্দিন আহমেদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন্দ ও হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির আহমদ আলী কাসেমী, বিকল্প ধারা বাংলাদেশের নির্বাহী সভাপতি মেজর (অব.) আবদুল মান্নান, বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, খেলাফত মজলিসের নেতা আহমেদ আবদুল কাদের, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব সাখাওয়াত হোসেন রাজী, ডেভেলপমেন্ট পার্টির চেয়ারম্যান এ কে এম আজহারুল ইসলাম, এবি পার্টির নেতা দিদারুল আলম ও জামায়াতের ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল। অনুষ্ঠানে কূটনীতিবিদদের মধ্যে ঢাকায় ভ্যাটিকান সিটির রাষ্ট্রদূত কেভিন এস রেন্ডাল, পাকিস্তান হাই কমিশনের কাউন্সেলর কামরান ধাঙ্গালও এসেছেন।

জুলাই অভ্যুত্থানের গর্ভে জন্ম নেওয়া নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দিয়ে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, তারা সামনের কথা বলতে চান, স্বপ্ন আর সম্ভাবনার বাংলাদেশের কথা বলতে চান। অতীতে বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে দুর্বল করে রাখার চেষ্টা হয়েছে মন্তব্য করে সেই পরিস্থিতি পাল্টে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ২৬ বছর বয়সী এই তরুণ নেতা।

এনসিপির আংশিক কমিটি ঘোষণার পর সমাপনী বক্তব্য দেওয়ার পাশাপাশি ঘোষণাপত্র পড়ে শোনান নাহিদ। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, বাংলাদেশে যে বিভাজনের রাজনীতি তৈরি করে বাংলাদেশের জনগণকে দুর্বল করে রেখে, রাষ্ট্রকে দুর্বল করে রাখার যে ষড়যন্ত্র তৈরি হয়েছিল, সেই ষড়যন্ত্র আমরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সকলের ঐক্যের মাধ্যমে ভেঙে দিয়েছি। আমরা আজকের এই মঞ্চ থেকে শপথ করতে চাই, বাংলাদেশকে আর কখনও বিভাজিত করা যাবে না। বাংলাদেশে ভারতপন্থি–পাকিস্তানপন্থি কোনো রাজনীতির ঠাঁই হবে না। আমরা বাংলাদেশকে সামনে রেখে, বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থকে সামনে রেখে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনীতি এবং রাষ্ট্র বিনির্মাণ করব।

নাহিদ ইসলাম বলেন, আজকে মঞ্চে দাঁড়িয়ে সামনের কথা বলতে চাই। আমরা পেছনের কথাকে অতিক্রম করে একটি সামনের সম্ভাবনার বাংলাদেশের, স্বপ্নের কথা বলতে চাই। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি। ছাত্র–জনতার মধ্য থেকে স্লোগান উঠেছিল, ‘তুমি কে আমি কে, বিকল্প বিকল্প’। আজকে সেই বিকল্পের জায়গা থেকে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘেটেছে।

এরপর নতুন দলের ঘোষণাপত্র পড়ে শোনান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব ছেড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে নাম লেখানো নাহিদ ইসলাম। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস তুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সাবেক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা হাজার বছরের ঐতিহাসিক পরিক্রমায় বঙ্গীয় বদ্বীপের জনগোষ্ঠী হিসেবে এক সমৃদ্ধ ও স্বকীয় সংস্কৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পত্তন ঘটে। তবে শোষণ ও বৈষম্য থেকে এ দেশের গণমানুষের মুক্তি মেলেনি। ফলে দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু স্বাধীনতার পর দীর্ঘসময় ধরে বাংলাদেশের জনগণকে বারবার গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে হয়েছে। ১৯৯০ সালে ছাত্র–জনতা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে সামরিক স্বৈরাচারকে হটিয়েছে। তথাপি, স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়েও আমরা গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে পারিনি। বরং বিগত ১৫ বছর দেশে একটি নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল, যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে বেপরোয়া ব্যবহার করে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে। বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ, গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকে একটি রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিতে পরিণত করা হয়েছে।

নাহিদ বলেন, জুলাই ২০২৪–এ ছাত্র–জনতা বিপুল আত্মত্যাগের মাধ্যমে এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটিয়েছে। কিন্তু আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে, হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন স্বাধীনতা কেবল একটি সরকার পতন করে আরেকটি সরকার বসানোর জন্যই ঘটেনি। জনগণ বরং রাষ্ট্রের আষ্টেপৃষ্ঠে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাক্সক্ষা থেকে এই অভ্যুত্থানে সাড়া দিয়েছিলে, যেন জনগণের অধিকারভিত্তিক একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠিত হয়। সেই লক্ষ্য নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে দলটির আহ্বায়ক বলেন, এটি হবে একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল।

নাহিদ বক্তৃতা শুরুর আগে মঞ্চের ঘোষক তাকে বিভিন্ন অভিধায় অভিহিত করেন। তার একটি ছিল ‘জুলাই অভ্যুত্থানের ইমাম’। বক্তৃতার এক পর্যায়ে নাহিদ বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সূচনা। একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদেরকে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সকল সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় গড়ে তোলা ও তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে আমাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার। এর মধ্য দিয়েই কেবল আমরা একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারব।

তিনি বলেন, নাগরিক পার্টি এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ চায়, যেখানে সমাজে ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বিভেদের বদলে ঐক্য, প্রতিশোধের বদলে ন্যায়বিচার এবং পরিবারতন্ত্রের বদলে মেধা ও যোগ্যতার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠিত হবে। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কোনো স্থান সেই রাজনীতিতে হবে না। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরকে মূলধারায় তুলে আনা হবে। আমাদের রিপাবলিকে সাধারণ মানুষ, একমাত্র সাধারণ মানুষই হবে ক্ষমতার সর্বময় উৎস। তাদের সকল ধরনের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকারের শক্তিশালী সুরক্ষাই হবে আমাদের রাজনীতির মূলমন্ত্র। আমরা রাষ্ট্রে বিদ্যমান জাতিগত, সামাজিক, লিঙ্গীয়, ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও বৈচিত্র্য রক্ষার মাধ্যমে একটি বহুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ করতে চাই। আমাদের রিপাবলিক সকল নাগরিককে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে শক্তিশালী সুরক্ষা প্রদান করবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর কোনো অংশকেই অপরায়ন করা হবে না। বরং রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে সমান গুরুত্ব প্রদান ও সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।

একটি ন্যায্যতা ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় নাগরিক পার্টির সংকল্প ঘোষণাপত্রে তুলে ধরেন দলের আহ্বায়ক। তিনি বলেন, চলুন আমরা একসঙ্গে, হাতে হাত রেখে, এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি যেখানে প্রতিটি নাগরিকের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হবে, যেখানে ন্যায় প্রতিষ্ঠা, মানুষের অধিকারের সংগ্রামই হবে রাজনীতির অন্যতম লক্ষ্য। যেখানে সাম্য ও মানবিক মর্যাদা হবে রাষ্ট্রের ভিত্তি। এখনই সময়– নতুন স্বপ্ন দেখার, নতুন পথচলার, এবং একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার!

পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, তরুণরা যেন তাদের নেতৃত্বে যারা বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে সেই খুনী, গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসরদের বিচার করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশে ৫৪ বছর পরে আমরা যে সুযোগ পেয়েছি, এতে একটি নতুন সংবিধানের বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, এই তরুণরা স্বপ্ন দেখে আগামীর বাংলাদেশ এক নতুন সংবিধানের মাধ্যমে পরিচালিত হবে।

সমাবেশে জাতীয় নাগরিক পাটির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি সম্মানবোধ থাকে আগামীর বাংলাদেশ হবে অপ্রতিরোধ্য। খুনি হাসিনা রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো নিজ হাতে ধ্বংস করে দিয়েছে। সকল রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করতে হবে। এসকল প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেই মানুষদের বসাতে হবে যারা যোগ্য। কোন ‘মাই ম্যান’কে বসানো যাবে না। এই খুনি হাসিনার বিচারের ব্যাপারে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কোন অপরাধীর জন্য যেন কেউ সুপারিশ না করি।

নতুন রাজনৈতিক দলের দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, যতদিন না পর্যন্ত এদেশ থেকে পরিবারতন্ত্র কবরস্থ হবে, আমরা ততদিন লড়ে যাবো। এদেশে কামারের ছেলে মন্ত্রী হবে, কুমারের ছেলে প্রধানমন্ত্রী হবে। যোগ্যতার ভিত্তিতে দেশের নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। তিনি বলেন, বিদেশের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকবে কিন্তু প্রেসক্রিপশনের সম্পর্ক থাকবে না। আমরা সুন্দর একটি বাংলাদেশ গড়তে চাই।

নতুন রাজনৈতিক দলের সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, আগামীর বাংলাদেশ হবে গণতন্ত্রের বাংলাদেশ। তরুণরা নেতৃত্ব দিয়ে চাঁদাবাজ ও দখলদারমুক্ত বাংলাদেশ গড়বে। আগামীর বাংলাদেশে আর আগের মতো রাতে ভোট হবে না। সব দলমত নির্বিশেষে সুখে শান্তিতে বসবাস করবে।

প্রসঙ্গত; জাতীয় নির্বাচন ডিসেম্বরে। সেই দিনক্ষণ সামনে রেখে এগোচ্ছে নির্বাচন কমিশন। জুনে ভোটার তালিকার কাজ শেষ হবে। দলগুলোর ভেতরে চলছে নিজেদের প্রার্থী বাছাইও। নির্বাচনি ট্রেনে চড়তে নতুন দলকে নিতে হবে নিবন্ধন। রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেই সবাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে না। দেশের নির্বাচন বা ভোটাধিকার সম্পর্কিত যতগুলো আইন আছে, তার মধ্যে একটি হলো আরপিও (রিপ্রেজেন্টেটিভ পিপলস অর্ডার) বা গণপ্রতিনিধিত্ব আইন। আরপিওর অধ্যায় ৬ক-তে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের কিছু শর্ত আছে। এ উদ্দেশ্যে নির্বাচন কমিশন ‘রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা, ২০০৮’ শীর্ষক একটি বিধিমালাও প্রণয়ন করেছে।

তিনটি শর্তের কথা বলা হয়েছে, নিবন্ধন পেতে হলে সেগুলোর যেকোনো একটি পূরণ করতে হবে। শর্তগুলোর মধ্যে আছে, স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত যেকোনো সংসদ নির্বাচনে দলীয় নির্বাচনি প্রতীক নিয়ে কমপক্ষে একটি আসনে জয়ী হওয়ার রেকর্ড থাকতে হবে। যে কোনো একটি আসনে দলীয় প্রার্থীকে মোট প্রদত্ত ভোটের পাঁচ শতাংশ পেতে হবে। কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি কেন্দ্রীয় কার্যালয়, অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর জেলা কার্যালয়, অন্তত ১০০টি উপজেলায় কার্যালয় এবং প্রতিটিতে সদস্য হিসেবে অন্তত ২০০ জন ভোটারের তালিকাভুক্তি থাকতে হবে।

এ ছাড়া নিবন্ধন পেতে আগ্রহী দলগুলোকে তাদের দলীয় গঠনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় কমিটিসহ দলের সব স্তরের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব অর্জন, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনকে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে না রাখা এবং বিভিন্ন নির্বাচনে প্রার্থিতার জন্য তৃণমূলের ভোটে প্যানেল প্রস্তুত করার বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান রাখার কথাও আইনে উল্লেখ আছে। যদি সংবিধান পরিপন্থী কিছু থাকে, তা হলে ওই দলকে তা সংশোধনের জন্য সময় দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, নতুন দল নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিবন্ধনের জন্য নতুন রাজনৈতিক দল আবেদন করে। তবে আইনে নির্বাচন কমিশন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করলে নিবন্ধনের আবেদন করা যাবে না এমন কিছু উল্লেখ নেই।

তিনি বলেন, নিবন্ধনের শর্তে বলা আছে, দলের গঠনতন্ত্রে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু থাকতে পারবে না। নতুন দলের সঙ্গে সংবিধানের সাংঘর্ষিক কিছু নেই বলেই মনে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি কেন্দ্রীয় কার্যালয়, অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর জেলা কার্যালয়, অন্তত ১০০ উপজেলায় কার্যালয় এবং প্রতিটিতে সদস্য হিসেবে অন্তত ২০০ জন ভোটারের তালিকাভুক্তি থাকতে হবে। রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ছাত্রদের নতুন দলে যোগ দেওয়ার লোকের অভাব হবে না। অনেক উপজেলায় তাদের কমিটিও আছে। তাই এসব শর্ত পূরণ করা তাদের জন্য সহজ বিষয় বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের আবেদন করার পর উপজেলা নির্বাচন অফিস থেকে তদন্ত প্রতিবেদনদ্রুত চলে আসবে। সব মিলিয়ে এক মাসের মধ্যেই নিবন্ধন সম্ভব বলে রফিকুল ইসলাম মনে করেন।

তিনি বলেন, প্রতীক বরাদ্দের ক্ষেত্রে নিবন্ধিত দলের কিংবা জাতীয় কোনো প্রতীকের মিল না থাকলে নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ দিতে কোনো বাধা নেই।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;

আপনার সামাজিক প্ল্যাটফর্ম এই পোস্ট শেয়ার করুন
লেখক তথ্য সম্পর্কে

জনপ্রিয় পোস্ট

তেলের ডিপোতে পড়ে সীতাকুণ্ডে একজনের মৃত্যু, দগ্ধ ৩

জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ, ভোটে অংশ নিতে লাগবে নিবন্ধন

আপডেটের সময় : ০৪:২২:০৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১ মার্চ ২০২৫

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের অংশগ্রহণে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি-এনসিপি) আত্মপ্রকাশ করেছে। তরুণদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের ঘোষণা দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি)। জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে নতুন এই রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ হয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বিশাল এক জনসভার মধ্য দিয়ে এ নতুন দলের আত্মপ্রকাশ হয়। জুলাই শহীদ মো. ইসমাইল হোসেন রাব্বির বোন মিম আক্তার জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে তিনি দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব আখতার হোসেনের নাম ঘোষণা করেন। পরে আংশিক কমিটির অন্যান্য সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন আখতার হোসেন।

সকাল থেকেই স্লোগানে স্লোগানে মিছিল নিয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জড়ো হন বিপুলসংখ্যক ছাত্র–জনতা। নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘিরে পতাকা হাতে নিয়ে, মাথায় পতাকা বেঁধে মিছিল নিয়ে তাদেরকে উচ্ছ্বাস করতে দেখা গেছে। বিকেল সাড়ে ৪টায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তারেক রেজার কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে সমাবেশের মূল পর্ব শুরু হয়। এরপর অন্যান্য ধর্মগ্রন্থসমূহ পাঠ এবং জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়। তারপর জুলাই–আগস্ট অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন এবং জুলাই অভ্যুত্থানের ওপর নির্মিত ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়েছে। পরে বক্তব্য রাখেন জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতৃবৃন্দ। অনুষ্ঠানে বিএনপি–জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা আকবর খান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের জেনারেল সেক্রেটারি মাওলানা জালাল উদ্দিন আহমেদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন্দ ও হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির আহমদ আলী কাসেমী, বিকল্প ধারা বাংলাদেশের নির্বাহী সভাপতি মেজর (অব.) আবদুল মান্নান, বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, খেলাফত মজলিসের নেতা আহমেদ আবদুল কাদের, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব সাখাওয়াত হোসেন রাজী, ডেভেলপমেন্ট পার্টির চেয়ারম্যান এ কে এম আজহারুল ইসলাম, এবি পার্টির নেতা দিদারুল আলম ও জামায়াতের ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল। অনুষ্ঠানে কূটনীতিবিদদের মধ্যে ঢাকায় ভ্যাটিকান সিটির রাষ্ট্রদূত কেভিন এস রেন্ডাল, পাকিস্তান হাই কমিশনের কাউন্সেলর কামরান ধাঙ্গালও এসেছেন।

জুলাই অভ্যুত্থানের গর্ভে জন্ম নেওয়া নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দিয়ে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, তারা সামনের কথা বলতে চান, স্বপ্ন আর সম্ভাবনার বাংলাদেশের কথা বলতে চান। অতীতে বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে দুর্বল করে রাখার চেষ্টা হয়েছে মন্তব্য করে সেই পরিস্থিতি পাল্টে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ২৬ বছর বয়সী এই তরুণ নেতা।

এনসিপির আংশিক কমিটি ঘোষণার পর সমাপনী বক্তব্য দেওয়ার পাশাপাশি ঘোষণাপত্র পড়ে শোনান নাহিদ। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, বাংলাদেশে যে বিভাজনের রাজনীতি তৈরি করে বাংলাদেশের জনগণকে দুর্বল করে রেখে, রাষ্ট্রকে দুর্বল করে রাখার যে ষড়যন্ত্র তৈরি হয়েছিল, সেই ষড়যন্ত্র আমরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সকলের ঐক্যের মাধ্যমে ভেঙে দিয়েছি। আমরা আজকের এই মঞ্চ থেকে শপথ করতে চাই, বাংলাদেশকে আর কখনও বিভাজিত করা যাবে না। বাংলাদেশে ভারতপন্থি–পাকিস্তানপন্থি কোনো রাজনীতির ঠাঁই হবে না। আমরা বাংলাদেশকে সামনে রেখে, বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থকে সামনে রেখে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনীতি এবং রাষ্ট্র বিনির্মাণ করব।

নাহিদ ইসলাম বলেন, আজকে মঞ্চে দাঁড়িয়ে সামনের কথা বলতে চাই। আমরা পেছনের কথাকে অতিক্রম করে একটি সামনের সম্ভাবনার বাংলাদেশের, স্বপ্নের কথা বলতে চাই। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি। ছাত্র–জনতার মধ্য থেকে স্লোগান উঠেছিল, ‘তুমি কে আমি কে, বিকল্প বিকল্প’। আজকে সেই বিকল্পের জায়গা থেকে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘেটেছে।

এরপর নতুন দলের ঘোষণাপত্র পড়ে শোনান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব ছেড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে নাম লেখানো নাহিদ ইসলাম। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস তুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সাবেক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা হাজার বছরের ঐতিহাসিক পরিক্রমায় বঙ্গীয় বদ্বীপের জনগোষ্ঠী হিসেবে এক সমৃদ্ধ ও স্বকীয় সংস্কৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পত্তন ঘটে। তবে শোষণ ও বৈষম্য থেকে এ দেশের গণমানুষের মুক্তি মেলেনি। ফলে দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু স্বাধীনতার পর দীর্ঘসময় ধরে বাংলাদেশের জনগণকে বারবার গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে হয়েছে। ১৯৯০ সালে ছাত্র–জনতা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে সামরিক স্বৈরাচারকে হটিয়েছে। তথাপি, স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়েও আমরা গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে পারিনি। বরং বিগত ১৫ বছর দেশে একটি নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল, যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে বেপরোয়া ব্যবহার করে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে। বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ, গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকে একটি রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিতে পরিণত করা হয়েছে।

নাহিদ বলেন, জুলাই ২০২৪–এ ছাত্র–জনতা বিপুল আত্মত্যাগের মাধ্যমে এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটিয়েছে। কিন্তু আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে, হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন স্বাধীনতা কেবল একটি সরকার পতন করে আরেকটি সরকার বসানোর জন্যই ঘটেনি। জনগণ বরং রাষ্ট্রের আষ্টেপৃষ্ঠে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাক্সক্ষা থেকে এই অভ্যুত্থানে সাড়া দিয়েছিলে, যেন জনগণের অধিকারভিত্তিক একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠিত হয়। সেই লক্ষ্য নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে দলটির আহ্বায়ক বলেন, এটি হবে একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল।

নাহিদ বক্তৃতা শুরুর আগে মঞ্চের ঘোষক তাকে বিভিন্ন অভিধায় অভিহিত করেন। তার একটি ছিল ‘জুলাই অভ্যুত্থানের ইমাম’। বক্তৃতার এক পর্যায়ে নাহিদ বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সূচনা। একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদেরকে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সকল সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় গড়ে তোলা ও তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে আমাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার। এর মধ্য দিয়েই কেবল আমরা একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারব।

তিনি বলেন, নাগরিক পার্টি এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ চায়, যেখানে সমাজে ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বিভেদের বদলে ঐক্য, প্রতিশোধের বদলে ন্যায়বিচার এবং পরিবারতন্ত্রের বদলে মেধা ও যোগ্যতার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠিত হবে। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কোনো স্থান সেই রাজনীতিতে হবে না। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরকে মূলধারায় তুলে আনা হবে। আমাদের রিপাবলিকে সাধারণ মানুষ, একমাত্র সাধারণ মানুষই হবে ক্ষমতার সর্বময় উৎস। তাদের সকল ধরনের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকারের শক্তিশালী সুরক্ষাই হবে আমাদের রাজনীতির মূলমন্ত্র। আমরা রাষ্ট্রে বিদ্যমান জাতিগত, সামাজিক, লিঙ্গীয়, ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও বৈচিত্র্য রক্ষার মাধ্যমে একটি বহুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ করতে চাই। আমাদের রিপাবলিক সকল নাগরিককে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে শক্তিশালী সুরক্ষা প্রদান করবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর কোনো অংশকেই অপরায়ন করা হবে না। বরং রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে সমান গুরুত্ব প্রদান ও সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।

একটি ন্যায্যতা ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় নাগরিক পার্টির সংকল্প ঘোষণাপত্রে তুলে ধরেন দলের আহ্বায়ক। তিনি বলেন, চলুন আমরা একসঙ্গে, হাতে হাত রেখে, এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি যেখানে প্রতিটি নাগরিকের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হবে, যেখানে ন্যায় প্রতিষ্ঠা, মানুষের অধিকারের সংগ্রামই হবে রাজনীতির অন্যতম লক্ষ্য। যেখানে সাম্য ও মানবিক মর্যাদা হবে রাষ্ট্রের ভিত্তি। এখনই সময়– নতুন স্বপ্ন দেখার, নতুন পথচলার, এবং একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার!

পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, তরুণরা যেন তাদের নেতৃত্বে যারা বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে সেই খুনী, গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসরদের বিচার করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশে ৫৪ বছর পরে আমরা যে সুযোগ পেয়েছি, এতে একটি নতুন সংবিধানের বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, এই তরুণরা স্বপ্ন দেখে আগামীর বাংলাদেশ এক নতুন সংবিধানের মাধ্যমে পরিচালিত হবে।

সমাবেশে জাতীয় নাগরিক পাটির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি সম্মানবোধ থাকে আগামীর বাংলাদেশ হবে অপ্রতিরোধ্য। খুনি হাসিনা রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো নিজ হাতে ধ্বংস করে দিয়েছে। সকল রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করতে হবে। এসকল প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেই মানুষদের বসাতে হবে যারা যোগ্য। কোন ‘মাই ম্যান’কে বসানো যাবে না। এই খুনি হাসিনার বিচারের ব্যাপারে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কোন অপরাধীর জন্য যেন কেউ সুপারিশ না করি।

নতুন রাজনৈতিক দলের দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, যতদিন না পর্যন্ত এদেশ থেকে পরিবারতন্ত্র কবরস্থ হবে, আমরা ততদিন লড়ে যাবো। এদেশে কামারের ছেলে মন্ত্রী হবে, কুমারের ছেলে প্রধানমন্ত্রী হবে। যোগ্যতার ভিত্তিতে দেশের নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। তিনি বলেন, বিদেশের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকবে কিন্তু প্রেসক্রিপশনের সম্পর্ক থাকবে না। আমরা সুন্দর একটি বাংলাদেশ গড়তে চাই।

নতুন রাজনৈতিক দলের সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, আগামীর বাংলাদেশ হবে গণতন্ত্রের বাংলাদেশ। তরুণরা নেতৃত্ব দিয়ে চাঁদাবাজ ও দখলদারমুক্ত বাংলাদেশ গড়বে। আগামীর বাংলাদেশে আর আগের মতো রাতে ভোট হবে না। সব দলমত নির্বিশেষে সুখে শান্তিতে বসবাস করবে।

প্রসঙ্গত; জাতীয় নির্বাচন ডিসেম্বরে। সেই দিনক্ষণ সামনে রেখে এগোচ্ছে নির্বাচন কমিশন। জুনে ভোটার তালিকার কাজ শেষ হবে। দলগুলোর ভেতরে চলছে নিজেদের প্রার্থী বাছাইও। নির্বাচনি ট্রেনে চড়তে নতুন দলকে নিতে হবে নিবন্ধন। রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেই সবাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে না। দেশের নির্বাচন বা ভোটাধিকার সম্পর্কিত যতগুলো আইন আছে, তার মধ্যে একটি হলো আরপিও (রিপ্রেজেন্টেটিভ পিপলস অর্ডার) বা গণপ্রতিনিধিত্ব আইন। আরপিওর অধ্যায় ৬ক-তে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের কিছু শর্ত আছে। এ উদ্দেশ্যে নির্বাচন কমিশন ‘রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা, ২০০৮’ শীর্ষক একটি বিধিমালাও প্রণয়ন করেছে।

তিনটি শর্তের কথা বলা হয়েছে, নিবন্ধন পেতে হলে সেগুলোর যেকোনো একটি পূরণ করতে হবে। শর্তগুলোর মধ্যে আছে, স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত যেকোনো সংসদ নির্বাচনে দলীয় নির্বাচনি প্রতীক নিয়ে কমপক্ষে একটি আসনে জয়ী হওয়ার রেকর্ড থাকতে হবে। যে কোনো একটি আসনে দলীয় প্রার্থীকে মোট প্রদত্ত ভোটের পাঁচ শতাংশ পেতে হবে। কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি কেন্দ্রীয় কার্যালয়, অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর জেলা কার্যালয়, অন্তত ১০০টি উপজেলায় কার্যালয় এবং প্রতিটিতে সদস্য হিসেবে অন্তত ২০০ জন ভোটারের তালিকাভুক্তি থাকতে হবে।

এ ছাড়া নিবন্ধন পেতে আগ্রহী দলগুলোকে তাদের দলীয় গঠনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় কমিটিসহ দলের সব স্তরের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব অর্জন, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনকে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে না রাখা এবং বিভিন্ন নির্বাচনে প্রার্থিতার জন্য তৃণমূলের ভোটে প্যানেল প্রস্তুত করার বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান রাখার কথাও আইনে উল্লেখ আছে। যদি সংবিধান পরিপন্থী কিছু থাকে, তা হলে ওই দলকে তা সংশোধনের জন্য সময় দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, নতুন দল নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিবন্ধনের জন্য নতুন রাজনৈতিক দল আবেদন করে। তবে আইনে নির্বাচন কমিশন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করলে নিবন্ধনের আবেদন করা যাবে না এমন কিছু উল্লেখ নেই।

তিনি বলেন, নিবন্ধনের শর্তে বলা আছে, দলের গঠনতন্ত্রে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু থাকতে পারবে না। নতুন দলের সঙ্গে সংবিধানের সাংঘর্ষিক কিছু নেই বলেই মনে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি কেন্দ্রীয় কার্যালয়, অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর জেলা কার্যালয়, অন্তত ১০০ উপজেলায় কার্যালয় এবং প্রতিটিতে সদস্য হিসেবে অন্তত ২০০ জন ভোটারের তালিকাভুক্তি থাকতে হবে। রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ছাত্রদের নতুন দলে যোগ দেওয়ার লোকের অভাব হবে না। অনেক উপজেলায় তাদের কমিটিও আছে। তাই এসব শর্ত পূরণ করা তাদের জন্য সহজ বিষয় বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের আবেদন করার পর উপজেলা নির্বাচন অফিস থেকে তদন্ত প্রতিবেদনদ্রুত চলে আসবে। সব মিলিয়ে এক মাসের মধ্যেই নিবন্ধন সম্ভব বলে রফিকুল ইসলাম মনে করেন।

তিনি বলেন, প্রতীক বরাদ্দের ক্ষেত্রে নিবন্ধিত দলের কিংবা জাতীয় কোনো প্রতীকের মিল না থাকলে নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ দিতে কোনো বাধা নেই।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;

আপনার সামাজিক প্ল্যাটফর্ম এই পোস্ট শেয়ার করুন