Dhaka ০৮:১৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

যথাযথ মর্যাদায় ইবাদত-বন্দেগিতে পবিত্র শবে বরাত পালিত

  • ইসলাম ডেস্ক ।। 
  • আপডেটের সময় : ০৭:১৮:৩৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • ৯০ টাইম ভিউ

সীতাকুণ্ড হযরত ইমামে আজম (রা.) জামে মসজিদে পবিত্র শবে বরাত পালন

রাত জেগে ইবাদত–বন্দেগি, পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, জিকির–আজকার ও নফল নামাজ আদায়সহ যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পবিত্র শবে বরাত পালিত হয়েছে। মহিমান্বিত এ রাতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বিগত জীবনের সব ভুলভ্রান্তি, পাপের জন্য গভীর অনুশোচনায় মহান আল্লাহ তাআলার দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। একইসাথে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে আগামীদিনের জন্য রহমত ও বরকত কামনা করেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিগণ। এছাড়া আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দিনে নফল রোজা রাখেন অনেকে।

গত শুক্রবার রাতে এশার নামাজের আগেই চট্টগ্রামের মসজিদে মসজিদে মুসল্লিদের ঢল নামে। এশার নামাজ শেষে মিলাদ মাহফিল ও বয়ান অনুষ্ঠিত হয়। বয়ানে বলা হয়, শব অর্থ রাত্রি, আর বরাত অর্থ অদৃষ্ট বা ভাগ্য। সুতরাং শবে বরাত অর্থ ভাগ্য রজনী। শবে বরাত বা ভাগ্য রজনী দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানের নিকট অতি পরিচিত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত। এ রাতে বান্দার ভালো–মন্দ, রুজি–রোজগার, হায়াত–মওত প্রভৃতি যাবতীয় বিষয় লিপিবদ্ধ করা হয়। উল্লিখিত কারণেই মানুষের কাছে শবে বরাতের গুরুত্ব অপরিসীম। মিলাদ মাহফিল শেষে মহান রবের বিশেষ দয়া চেয়ে বিশেষ মুনাজাত পরিচালিত হয়।

মিলাদ এবং বয়ান শেষেও বহু মুসল্লি মসজিদে জিকির আজকার এবং কোরান তেলাওয়াতে মশগুল থাকেন।

লাইলাতুল বরাতের রাতে বিপুল সংখ্যক মুসল্লি মরহুম স্বজনদের কবর জিয়ারত এবং বিভিন্ন অলি–আউলিয়ার মাজার জিয়ারত করেন। প্রতিটি মাজারে ভীড় ছিল লক্ষ্যণীয়। শবে বরাত উপলক্ষে নগরীর পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মসজিদে–মাজারে মানুষের ঢল নামে। প্রতিটি মসজিদ মাজারে আলোকসজ্জা করা হয়েছিল।

শবে বরাত নির্বিঘ্নে উদযাপনের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের সর্বত্র আইনশৃক্সখলা বাহিনীর তৎপরতা ছিল লক্ষ্যণীয়।

চট্টগ্রামের তৈরি হয় ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ উৎসবমুখর পরিস্থিতি । চট্টগ্রামের এ দু’টি বড় মসজিদ জমিয়াতুল ফালাহ এবং আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে হাজার–হাজার মুসল্লির সমাগম ঘটে শবে বরাতের রাতে।

শুধু মসজিদ নয়, নগরীতে মুসলিম ধর্মাবলম্বী সাধকদের ঐতিহাসিক মাজারগুলোতেও উপচেপড়া ভীড় তৈরি হয়। নগরীতে শাহসুফি হজরত আমানত খান শাহ’র দরগাহ মসজিদ, মিসকিন শাহ’র মাজার, গরীব উল্লাহ শাহ’র দরগাহও প্রতিবছরের মতো লোকে–লোকারণ্য হয়ে উঠে মহামান্বিত এই রাতে।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ঐতিহাসিক মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফেও যেন লাখো মানুষের ঢল নেমেছে। নানা বয়সী, বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার লোকজন, ধনী–গরীব নির্বিশেষে এক কাতারে এসে ইবাদত–বন্দেগির মাধ্যমে রাতটি পার করেছেন।

পবিত্র লাইলাতুল বরাত যথাযোগ্য মর্যাদায় সীতাকুণ্ড সলিমপুর ফকিরহাটের পশ্চিম পাড়াস্থ হযরত ইমামে আজম (রা.) জামে মসজিদে গতকাল পালিত হয়েছে। ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা ইবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে এ রাত কাটিয়ে দেন। তাছাড়া বাদ এশা হযরত ইমামে আজম (রা.) জামে মসজিদে আলোচনা সভা, দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।

এ সময় পবিত্র লাইলাতুল বরাত এর উপর আলোচনায় অংশ নেন ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের প্রভাষক আবু মুহাম্মদ মুশফিক ইলাহী । এ সময় আরো বক্তব্য রাখেন হাফেজ মাওলানা মামুনুর রশিদ ।

এ সময় দীর্ঘ আলোচনায় আবু মুহাম্মদ মুশফিক ইলাহী বলেন, শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। শবে বরাত কথাটি ফারসি থেকে এসেছে। ‘শব’ মানে রাত, ‘বরাত’ মানে মুক্তি। শবে বরাত অর্থ মুক্তির রাত। শবে বরাতের আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারাআত’। হাদিস শরিফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা ‘শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী’ বলা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশ, পারস্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দিসহ নানা ভাষায় যা ‘শবে বরাত’ নামেই অধিক পরিচিত।

কোরআনুল কারিমে এসেছে, ‘হা-মিম! শপথ! উজ্জ্বল কিতাবের, নিশ্চয়ই আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয়ই আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয়ই আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি।’ (সুরা-৪৪ দুখান, আয়াত: ১-৫)। মুফাসসিরিনগণ বলেন: এখানে ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা বরকতময় রজনী বলে শাবান মাসে পূর্ণিমা রাতকেই বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি, রুহুল মাআনি ও রুহুল বায়ান)। হজরত ইকরিমা (রা.) প্রমুখ কয়েকজন তাফসিরবিদ থেকে বর্ণিত আছে, সুরা দুখান–এর দ্বিতীয় আয়াতে বরকতের রাত বলে শবে বরাতকে বোঝানো হয়েছে। (মাআরিফুল কোরআন)।

হাদিস শরিফে আছে, ‘হজরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধশাবানের রাতে মাখলুকাতের দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (ইবনে হিব্বান: ৫৬৬৫, ইবনে মাজাহ: ১৩৯০, রাজিন: ২০৪৮; ইবনে খুজাইমা, কিতাবুত তাওহিদ, পৃষ্ঠা: ১৩৬, মুসনাদে আহমদ, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৭৬)।

হজরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সিজদা করলেন যে আমার ধারণা হলো তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ করে বললেন, “হে আয়শা! তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে?” আমি উত্তরে বললাম, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘তুমি কি জানো এটা কোন রাত?’ আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলই ভালো জানেন।’ তখন নবীজি (সা.) বললেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন, ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন।’ (শুআবুল ইমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮২)।

শবে বরাত পালনের তাৎপর্য সম্পর্কে তিনি বলেন , হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে: নবীজি (সা.) এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন। তিনি আরও বলেন, নবীজি (সা.) তাঁকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া–বকরির পশমের (সংখ্যার পরিমাণের) চেয়েও বেশিসংখ্যক গুনাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি: ৭৩৯)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন শাবানের মধ্য দিবস আসবে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করবে ও দিনে রোজা পালন করবে। (ইবনে মাজাহ)। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাত ইবাদত–বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো। কেননা, এদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং আহ্বান করেন, ‘কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছো কি? আমি ক্ষমা করব; কোনো রিজিক প্রার্থী আছ কি? আমি রিজিক দেব; আছ কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি উদ্ধার করব।’ এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহ মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ: ১৩৮৪)।

শবে বরাতে করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে তিনি বলেন , এ ছাড়া প্রতি মাসের ৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামেবিদের নফল রোজা তো আছেই, যা হজরত আদম (আ.) পালন করেছিলেন এবং আমাদের প্রিয় নবী (সা.)ও পালন করতেন, যা মূলত সুন্নাত। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ফকিহ হাফিজ ইবনে রজব (রা.) বলেন, এদিনের রোজা আইয়ামেবিদের রোজার অন্তর্ভুক্ত। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা: ১৫১)।

এ ছাড়া মাসের প্রথম তারিখ, মধ্য তারিখ ও শেষ তারিখ নফল রোজা গুরুত্বপূর্ণ। শবে বরাতের রোজা এর আওতায়ও পড়ে। সওমে দাউদি পদ্ধতিতে এক দিন পর এক দিন রোজা পালন করলেও প্রতিটি বিজোড় তারিখ রোজা হয় এবং শবে বরাতের রোজার শামিল হয়ে যায়। সর্বোপরি রাসুল (সা.) রমজান মাসের পর রজব-শাবান মাসে বেশি নফল নামাজ ও নফল রোজা পালন করতেন, শাবান মাসে কখনো ১০টি, কখনো ১৫টি, কখনো ২০টি নফল রোজা, কখনো আরও বেশি রাখতেন। এমনকি উম্মুহাতুল মুমিনিনগণ বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসে এভাবে নফল রোজা রাখা শুরু করতেন, মনে হতো, তিনি আর কখনো রোজা ছাড়বেন না। (মুসলিম)।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;

আপনার সামাজিক প্ল্যাটফর্ম এই পোস্ট শেয়ার করুন
লেখক তথ্য সম্পর্কে

জনপ্রিয় পোস্ট

আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ইশরাককে শপথ পড়ানো যাবে না: রিটকারীর আইনজীবী

যথাযথ মর্যাদায় ইবাদত-বন্দেগিতে পবিত্র শবে বরাত পালিত

আপডেটের সময় : ০৭:১৮:৩৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

রাত জেগে ইবাদত–বন্দেগি, পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, জিকির–আজকার ও নফল নামাজ আদায়সহ যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পবিত্র শবে বরাত পালিত হয়েছে। মহিমান্বিত এ রাতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বিগত জীবনের সব ভুলভ্রান্তি, পাপের জন্য গভীর অনুশোচনায় মহান আল্লাহ তাআলার দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। একইসাথে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে আগামীদিনের জন্য রহমত ও বরকত কামনা করেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিগণ। এছাড়া আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দিনে নফল রোজা রাখেন অনেকে।

গত শুক্রবার রাতে এশার নামাজের আগেই চট্টগ্রামের মসজিদে মসজিদে মুসল্লিদের ঢল নামে। এশার নামাজ শেষে মিলাদ মাহফিল ও বয়ান অনুষ্ঠিত হয়। বয়ানে বলা হয়, শব অর্থ রাত্রি, আর বরাত অর্থ অদৃষ্ট বা ভাগ্য। সুতরাং শবে বরাত অর্থ ভাগ্য রজনী। শবে বরাত বা ভাগ্য রজনী দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানের নিকট অতি পরিচিত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত। এ রাতে বান্দার ভালো–মন্দ, রুজি–রোজগার, হায়াত–মওত প্রভৃতি যাবতীয় বিষয় লিপিবদ্ধ করা হয়। উল্লিখিত কারণেই মানুষের কাছে শবে বরাতের গুরুত্ব অপরিসীম। মিলাদ মাহফিল শেষে মহান রবের বিশেষ দয়া চেয়ে বিশেষ মুনাজাত পরিচালিত হয়।

মিলাদ এবং বয়ান শেষেও বহু মুসল্লি মসজিদে জিকির আজকার এবং কোরান তেলাওয়াতে মশগুল থাকেন।

লাইলাতুল বরাতের রাতে বিপুল সংখ্যক মুসল্লি মরহুম স্বজনদের কবর জিয়ারত এবং বিভিন্ন অলি–আউলিয়ার মাজার জিয়ারত করেন। প্রতিটি মাজারে ভীড় ছিল লক্ষ্যণীয়। শবে বরাত উপলক্ষে নগরীর পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মসজিদে–মাজারে মানুষের ঢল নামে। প্রতিটি মসজিদ মাজারে আলোকসজ্জা করা হয়েছিল।

শবে বরাত নির্বিঘ্নে উদযাপনের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের সর্বত্র আইনশৃক্সখলা বাহিনীর তৎপরতা ছিল লক্ষ্যণীয়।

চট্টগ্রামের তৈরি হয় ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ উৎসবমুখর পরিস্থিতি । চট্টগ্রামের এ দু’টি বড় মসজিদ জমিয়াতুল ফালাহ এবং আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে হাজার–হাজার মুসল্লির সমাগম ঘটে শবে বরাতের রাতে।

শুধু মসজিদ নয়, নগরীতে মুসলিম ধর্মাবলম্বী সাধকদের ঐতিহাসিক মাজারগুলোতেও উপচেপড়া ভীড় তৈরি হয়। নগরীতে শাহসুফি হজরত আমানত খান শাহ’র দরগাহ মসজিদ, মিসকিন শাহ’র মাজার, গরীব উল্লাহ শাহ’র দরগাহও প্রতিবছরের মতো লোকে–লোকারণ্য হয়ে উঠে মহামান্বিত এই রাতে।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ঐতিহাসিক মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফেও যেন লাখো মানুষের ঢল নেমেছে। নানা বয়সী, বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার লোকজন, ধনী–গরীব নির্বিশেষে এক কাতারে এসে ইবাদত–বন্দেগির মাধ্যমে রাতটি পার করেছেন।

পবিত্র লাইলাতুল বরাত যথাযোগ্য মর্যাদায় সীতাকুণ্ড সলিমপুর ফকিরহাটের পশ্চিম পাড়াস্থ হযরত ইমামে আজম (রা.) জামে মসজিদে গতকাল পালিত হয়েছে। ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা ইবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে এ রাত কাটিয়ে দেন। তাছাড়া বাদ এশা হযরত ইমামে আজম (রা.) জামে মসজিদে আলোচনা সভা, দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।

এ সময় পবিত্র লাইলাতুল বরাত এর উপর আলোচনায় অংশ নেন ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের প্রভাষক আবু মুহাম্মদ মুশফিক ইলাহী । এ সময় আরো বক্তব্য রাখেন হাফেজ মাওলানা মামুনুর রশিদ ।

এ সময় দীর্ঘ আলোচনায় আবু মুহাম্মদ মুশফিক ইলাহী বলেন, শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। শবে বরাত কথাটি ফারসি থেকে এসেছে। ‘শব’ মানে রাত, ‘বরাত’ মানে মুক্তি। শবে বরাত অর্থ মুক্তির রাত। শবে বরাতের আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারাআত’। হাদিস শরিফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা ‘শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী’ বলা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশ, পারস্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দিসহ নানা ভাষায় যা ‘শবে বরাত’ নামেই অধিক পরিচিত।

কোরআনুল কারিমে এসেছে, ‘হা-মিম! শপথ! উজ্জ্বল কিতাবের, নিশ্চয়ই আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয়ই আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয়ই আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি।’ (সুরা-৪৪ দুখান, আয়াত: ১-৫)। মুফাসসিরিনগণ বলেন: এখানে ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা বরকতময় রজনী বলে শাবান মাসে পূর্ণিমা রাতকেই বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি, রুহুল মাআনি ও রুহুল বায়ান)। হজরত ইকরিমা (রা.) প্রমুখ কয়েকজন তাফসিরবিদ থেকে বর্ণিত আছে, সুরা দুখান–এর দ্বিতীয় আয়াতে বরকতের রাত বলে শবে বরাতকে বোঝানো হয়েছে। (মাআরিফুল কোরআন)।

হাদিস শরিফে আছে, ‘হজরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধশাবানের রাতে মাখলুকাতের দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (ইবনে হিব্বান: ৫৬৬৫, ইবনে মাজাহ: ১৩৯০, রাজিন: ২০৪৮; ইবনে খুজাইমা, কিতাবুত তাওহিদ, পৃষ্ঠা: ১৩৬, মুসনাদে আহমদ, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৭৬)।

হজরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সিজদা করলেন যে আমার ধারণা হলো তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ করে বললেন, “হে আয়শা! তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে?” আমি উত্তরে বললাম, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘তুমি কি জানো এটা কোন রাত?’ আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলই ভালো জানেন।’ তখন নবীজি (সা.) বললেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন, ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন।’ (শুআবুল ইমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮২)।

শবে বরাত পালনের তাৎপর্য সম্পর্কে তিনি বলেন , হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে: নবীজি (সা.) এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন। তিনি আরও বলেন, নবীজি (সা.) তাঁকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া–বকরির পশমের (সংখ্যার পরিমাণের) চেয়েও বেশিসংখ্যক গুনাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি: ৭৩৯)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন শাবানের মধ্য দিবস আসবে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করবে ও দিনে রোজা পালন করবে। (ইবনে মাজাহ)। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাত ইবাদত–বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো। কেননা, এদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং আহ্বান করেন, ‘কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছো কি? আমি ক্ষমা করব; কোনো রিজিক প্রার্থী আছ কি? আমি রিজিক দেব; আছ কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি উদ্ধার করব।’ এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহ মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ: ১৩৮৪)।

শবে বরাতে করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে তিনি বলেন , এ ছাড়া প্রতি মাসের ৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামেবিদের নফল রোজা তো আছেই, যা হজরত আদম (আ.) পালন করেছিলেন এবং আমাদের প্রিয় নবী (সা.)ও পালন করতেন, যা মূলত সুন্নাত। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ফকিহ হাফিজ ইবনে রজব (রা.) বলেন, এদিনের রোজা আইয়ামেবিদের রোজার অন্তর্ভুক্ত। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা: ১৫১)।

এ ছাড়া মাসের প্রথম তারিখ, মধ্য তারিখ ও শেষ তারিখ নফল রোজা গুরুত্বপূর্ণ। শবে বরাতের রোজা এর আওতায়ও পড়ে। সওমে দাউদি পদ্ধতিতে এক দিন পর এক দিন রোজা পালন করলেও প্রতিটি বিজোড় তারিখ রোজা হয় এবং শবে বরাতের রোজার শামিল হয়ে যায়। সর্বোপরি রাসুল (সা.) রমজান মাসের পর রজব-শাবান মাসে বেশি নফল নামাজ ও নফল রোজা পালন করতেন, শাবান মাসে কখনো ১০টি, কখনো ১৫টি, কখনো ২০টি নফল রোজা, কখনো আরও বেশি রাখতেন। এমনকি উম্মুহাতুল মুমিনিনগণ বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসে এভাবে নফল রোজা রাখা শুরু করতেন, মনে হতো, তিনি আর কখনো রোজা ছাড়বেন না। (মুসলিম)।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;

আপনার সামাজিক প্ল্যাটফর্ম এই পোস্ট শেয়ার করুন