স্বর্ণ পাচারের ঘটনায় শাহ্আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ জব্দের পর ১১ দিন পার হয়েছে। সেই উড়োজাহাজে জব্দ ২ কোটি ৬০ লাখ টাকার স্বর্ণের বাহক কে বা কারা পাচারে জড়িত এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। স্বর্ণ পাচারে জড়িত চক্রের কেউ ধরা পড়েনি
জড়িতরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। দালিলিকভাবে জব্দ করা সেই উড়োজাহাজের পাইলট-ক্রুদের এখনও জিজ্ঞাসাবাদই করা হয়নি। শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ বলছে, জিজ্ঞাসাবাদসহ পাচারের ঘটনা তদন্ত করবে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষ বলছে, এখনও উড়োজাহাজের পাইলট-ক্রুদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। অন্যদিকে কাস্টমসের পক্ষ থেকে এখনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়নি উড়োজাহাজ।
শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক মিনাহাজ উদ্দিন সময়ের আলোকে বলেন, আমরা বিমানটি দালিলিকভাবে জব্দ করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কাস্টমসে পাঠিয়ে দিয়েছি। শুল্ক গোয়েন্দাদের পক্ষ থেকে দুটি মামলা করা হয়েছে। একটি মামলা করা হয়েছে স্বর্ণ পাচারের দায়ে গ্রেফতার মহিলাকে থানায় হস্তান্তরের সময়। আরেকটি মামলা করা হয়েছে কাস্টমসে। এখন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব তথ্য উদঘাটনে জিজ্ঞাসাবাদসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা। তবে এসব কাজ কতটুকু এগিয়েছে এই মুহূর্তে জানি না।
বিমানের চট্টগ্রাম স্টেশন ব্যবস্থাপক সেলিম উল্লাহ সময়ের আলোকে বলেন, বিমানটি দালিলিকভাবে জব্দ হলেও নিয়মিতভাবে যাত্রী বহন করছে। জব্দ করা হয়েছে শুনেছি। তবে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে বিমানটি একাধিকবার ওঠানামা করলেও পাইলট কিংবা ক্রুদের কাস্টমসের পক্ষ থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। জিজ্ঞাসাবাদ করলে আমাকে জানানো হতো।
গত ২৬ ডিসেম্বর সকালে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ‘বোয়িং ৭৭৭-ইআর’ মডেলের উড়োজাহাজটি জব্দ করা হয়। এটি দুবাই থেকে যাত্রী নিয়ে শাহ আমানতে এসেছিল। বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট ‘বিজি-১৪৮’ হিসেবে ব্যবহৃত উড়োজাহাজটি মূলত বোয়িং-৭৭৭ মডেলের বিমান।
ঘটনার দিন বিমানের ফ্লাইট থেকে স্বর্ণের বার উদ্ধারের ঘটনায় এক নারীকে আটক করা হয়। সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ ওই দিন বিকালে তাকে নগরীর পতেঙ্গা থানায় সোপর্দ করেছে। তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর।
শুল্ক গোয়েন্দা অধিদদফতর জানায়, স্বর্ণের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এক নারীকে আটক করা হয়েছিল। ওই নারী অনলাইনে স্বর্ণ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বর্ণ ব্যবসার সঙ্গে তিনি জড়িত বলে মৌখিকভাবে স্বীকার করেছেন। তার ভিজিটিং কার্ডেও এমন তথ্য পাওয়া গেছে। উদ্ধার ২০টি স্বর্ণের বারের ওজন ২ দশমিক ৩২ কেজি। আনুমানিক মূল্য ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বিমানের ‘৯-জে’ সিটের নিচে প্লাস্টিক টেপ দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় ২০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, বাংলাদেশ বিমানের ‘বিজি ১৪৮’ ফ্লাইটটি ঢাকা-চট্টগ্রাম-দুবাই এবং দুবাই-চট্টগ্রাম-ঢাকা পথে নিয়মিত চলাচল করে। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর দালিলিকভাবে জব্দের পর নিয়মিতভাবেই শাহ আমানতে আসা-যাওয়া করছে। এর মধ্যে ১১ দিন পার হলেও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কেউ পাইলট ক্রুদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে শাহ আমানতে আসেননি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শাহ আমানতসহ ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট স্বর্ণ পাচারে জড়িত। এ ধরনের বড় চালান একাধিকবার জব্দ হয়েছে। জব্দের পর কিছুদিন হইচই হলেও পরে চাপা পড়ে যায় পুরো ঘটনা। গেল তিন বছরে বড় স্বর্ণ চালান জব্দের একাধিক ঘটনা ঘটলেও পাচারকারীরা আড়ালেই রয়ে গেছে।
জব্দ করা বিমানের পাইলট-ক্রুদের এখনও কেন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি তা জানতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও এ বিষয়ে কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
সিএমপির পতেঙ্গা থানার ওসি মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, ২ কোটি ৬০ লাখ টাকার স্বর্ণের বার জব্দের ঘটনার দিন একটি মামলা হয়েছিল। ওই মামলায় গ্রেফতার নারীকে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানো হয়েছে। মামলাটি থানার একজন সাব-ইন্সপেক্টর তদন্ত করছেন।
বিমানের এমডিকে লেখা চিঠিতে যা আছে :
বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর ২৬ ডিসেম্বর শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক সৈয়দ মুসফিকুর রহমান একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে অবতরণ করা বিভিন্ন বিমানে চোরাচালানের উদ্দেশ্যে আনা স্বর্ণ শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর আটক করে থাকে। পাচারের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। যাত্রীবাহী বিমান বিবেচনায় বিমানগুলোকে অন্তর্বর্তীকালীন ছাড় দেওয়া হয়। এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। বিমানের সিটের নিচে, বাথরুমে পাইপের নিচে, ক্যাটারিং এরিয়ায় অভিনব কায়দায় স্বর্ণ লুকায়িত থাকে, যা সংশ্লিষ্ট এয়ার লাইন্সের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত না থাকলে এ ধরনের অপতৎপরতা সংঘটিত করা সম্ভব নয়। বর্ণিত প্রেক্ষাপটে উড়োজাহাজের অভ্যন্তরে বিভিন্নভাবে লুকিয়ে চোরাচালান যাতে হতে না পারে সে লক্ষ্যে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আপনাকে অনুরোধ করা হলো।’
নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন সেই নারী
২৬ ডিসেম্বর রাজশাহীর বোয়ালিয়া এলাকার মেয়ে আতিয়া সামিয়াকে ২ কোটি ৬০ লাখ টাকার স্বর্ণ পাচারে জড়িত সন্দেহে আটক করা হয়েছিল। তার কাছে পাওয়া যায় ভিজিটিং কার্ড। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি অনলাইনে স্বর্ণ কেনাবেচায় জড়িত বলে স্বীকার করেন। জব্দ ১১৬ গ্রাম ওজনের ২০ স্বর্ণ বারের ওজন ছিল ২ কেজি ৩২ গ্রাম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিভিল অ্যাভিয়েশনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, আতিয়া সামিয়া নিয়মিতভাইে শাহ আমানতে আসা-যাওয়া করতেন। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আর শাহ আমানত হয়ে যাওয়া-আসার সময় বহন করতেন চোরাচালান পণ্য। স্বর্ণের পাশাপাশি তিনি আরও অনেক ধরনের পণ্য পাচারে জড়িত বলে গ্রেফতারের দিনই সন্দেহ করেন গোয়েন্দারা। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ এ ঘটনা যথাযথভাবে তদন্ত করলে বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের চক্র ধরা পড়বে। না হয় স্বর্ণ চোরাচালানসহ কোনো ধরনের অবৈধ পণ্য পাচারে জড়িতরা আড়ালেই থেকে যাবে। একসময় পুরো ঘটনাই চাপা পড়ে যাবে। – সময়ের আলো ।
খালেদ / পোস্টকার্ড ;