চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে সারা দেশের মোট শিম উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশের বেশি শিম উৎপাদন হতো । যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হয় বিদেশেও। কিন্তু ক্রমেই এখানে কমছে শিমের আবাদ। আর এর প্রভাব পড়ছে রপ্তানিতেও।
সীতাকুণ্ডকে বলা হয় শিমের রাজ্য। কেননা সারা বছরই এ উপজেলায় শিম চাষ অন্য এলাকার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০ সালের এক হিসেবে দেখা যায় দেশে প্রতিবছর ২০ হাজার ৮৮০ হেক্টর জমিতে শিম চাষ হয়। আর শিম উৎপাদন হয় ১ লাখ ৪৪ হাজার ৫০ টন। এর মধ্যে শুধু সীতাকুণ্ডেই ৩ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ৫৪ হাজার টন শিম।
শিমের আবাদ কম হওয়ার কারণ হিসেবে উপজেলা কৃষি বিভাগ স্থানীয় বাজারে উৎপাদিত শিমের কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়াকেই দায়ী করছে । যদিও স্থানীয় সূত্র ও উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে গত ৫ বছরে সীতাকুণ্ডের সৈয়দপুর ইউনিয়ন থেকে বাঁশবাড়িয়া পর্যন্ত বেশির ভাগ কৃষি জমিতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান। এতে এ উপজেলায় ব্যাপক হারে কমেছে কৃষি জমি। তবে ঠিক কি পরিমাণ কৃষি জমি কমেছে কিংবা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো কী পরিমাণ জমি কিনে নিয়েছে তার সঠিক হিসাব দিতে পারেনি উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস। এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই উপজেলা কৃষি বিভাগের কাছেও।
মূলত আবহাওয়া ও পরিবেশ শিম চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী হওয়ায় গত কয়েক দশক ধরে বংশপরম্পরায় শিম চাষ করে আসছেন এখানকার কয়েক হাজার কৃষক। শীত মৌসুমে চাষ হওয়া এখানকার স্থানীয় জাতের মধ্যে কার্তিক গোটা, কার্তিক বাটা, ছুরি, পুঁটি উল্লেখযোগ্য।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সীতাকুণ্ডে প্রতি হেক্টর জমিতে ১৮ টন শিম উৎপাদন হয়। যদিও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে হেক্টর প্রতি শিমের উৎপাদন ১৬ টনের মতো। কিন্তু গত দুই বছরে সীতাকুণ্ডে শিমের চাষ ও উৎপাদন প্রায় ১০ শতাংশ কমে গেছে। এ বছর উৎপাদন আরও কমার আশঙ্কা করছে কৃষি বিভাগ। ২০২০ ও ২০২১ সালে যেখানে সীতাকুণ্ডে শিম চাষ হয়েছিল ৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেখানে ২০২২ সালে ২ হাজার ৭০০ হেক্টর ও ২০২৩ সালে কমে তা ২ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে দাঁড়িয়েছে। এ উৎপাদন কমার প্রভাব পড়েছে শিম রপ্তানিতেও।
চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্রের রোগতত্ত্ববিদ সৈয়দ মনিরুল হক খবরের কাগজকে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে তাপনিয়ন্ত্রিত কনটেইনারে করে সমুদ্রপথে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৬৮ দশমিক ৫৯ টন শিমের বিচি রপ্তানি হয়েছিল যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে। ২০২২-২৩ সালে রপ্তানি কমে ৪৪৭ দশমিক ৫ টনে নেমেছে।
শিম চাষ কমার প্রধান কারণ হিসেবে কৃষি উপকরণ, বাঁশের কঞ্চি, সার, কীটনাশক ও শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিকে দেখা হচ্ছে। যে পরিমাণ অর্থ, সময় ও শ্রম কৃষকদের ব্যয় হচ্ছে সেই অনুপাতে লাভ পাচ্ছেন না কৃষকরা। আবার প্রায় একই খরচে অন্যান্য সবজি যেমন টমেটো, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, বরবটি চাষে শিমের চাইতে বেশি লাভবান হওয়ায় চাষিরা সেসব সবজি চাষের দিকে ঝুঁকছেন।বিশেষ করে বাঁশের কঞ্চির দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
উপজেলার বারৈয়ারঢালা ইউনিয়নের কৃষক আবু তাহের বলেন, ‘সীতাকুণ্ডে শিমের ফলন সবচেয়ে বেশি হয়। কেননা শিম লতার একটি বোটা থেকে বিশেষ কায়দায় শিম ছিঁড়তে পারলে একই বোটা থেকে তিন থেকে চারবার ফলন হয়। যা সীতাকুণ্ড উপজেলার কৃষকেরা বংশপরম্পরায় করে আসছেন। এ ছাড়া এখানে শীত আসার আগেই শিম চাষ শুরু হয়। গত বছর আমি প্রায় ৪০০ শতক জমিতে শিমের চাষ করেছিলাম। তবে বাঁশের কঞ্চি, সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় লাভ হয়েছিল কম। এই বছর ২৪০ শতক জমিতে শিমের চাষ করেছি। বাকি জমিতে টমেটো, লাউ ও মিষ্টি কুমড়া লাগিয়েছি। একই খরচে অন্য সবজিতে লাভবান হচ্ছি সেজন্য শিম কম করছি।’
একই এলাকার নুরুদ্দীন নামে আরেক কৃষক বলেন, ‘শিম মৌসুমের শুরুর প্রথম মাস কেজিতে ৭০-৮০ টাকা দাম পাওয়া গেলেও পরে তা ২৫-৩০ টাকায় নেমে আসে। এতে আমাদের লাভ হয় নগণ্য। অন্যদিকে মৌসুমজুড়ে অন্যান্য সবজির দাম ভালো পাওয়া যায়। তাই সেগুলোতে লাভ হয় ভালো। এজন্য শিমের পাশাপাশি অন্য সবজি চাষে আমরা মনোযোগ দিয়েছি।’
সীতাকুণ্ড উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাবিবউল্লাহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘শিম খরাসহিষ্ণু একটি লতা জাতীয় সবজি যা শুষ্ক আবহাওয়ায় ভালো উৎপাদন হয়। সীতাকুণ্ডের ভৌগোলিক অবস্থান ও আবহাওয়া শিম চাষের জন্য আদর্শ হওয়ায় এখানে শিমের ফলন বেশি হয়। এখানে বংশপরম্পরায় কার্তিককোট, ছুরি, পুঁটি, বাটা, রূপবানসহ ছয় ধরনের শিমের চাষ হয়ে আসছে কয়েক দশক ধরে। বিশেষ করে সীতাকুণ্ডের সৈয়দপুর ও বারৈয়াঢালা ইউনিয়নে সবচেয়ে শিমের আবাদ হয়। একসময় দেশের মোট শিম উৎপাদনের দুই-তৃতীয়াংশই হতো সীতাকুণ্ডে। আকারে বড় ও দেখতে সুন্দর হওয়ায় এখানে উৎপাদিত শিমে কদর বাড়তে থাকে। চট্টগ্রামের আশেপাশের জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এ শিম পৌঁছে যায় পাইকারদের মাধ্যমে। দামও পাওয়া যেত বেশ ভালো।’
তিনি আরও বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখানকার উচ্চফলনশীল জাতগুলো ও শিমের চাষ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেশের বিভিন্ন জেলায় বাড়তে থাকে শিমের উৎপাদন যার ফলে কমতে থাকে সীতাকুণ্ডের শিমের চাহিদা ও দাম। উৎপাদন ব্যয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দাম ও চাহিদা কমে যাওয়ায় শিম চাষের আগ্রহ হারিয়ে অন্যান্য সবজি চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা। শিল্প প্রতিষ্ঠানের আধিক্যে কৃষি জমি কমে যাওয়াও একটি কারণ।’
খালেদ / পোস্টকার্ড ;