- মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে মৃত্যু বেড়ে ৩২ : আইসিইউতে ১১ জন
- ৬ লাশের স্যাম্পল সিআইডির কাছে, ২২ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ
- রোববার পর্যন্ত মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের সব কার্যক্রম বন্ধ
- লাশ গোপনের তথ্য একেবারেই সঠিক নয়
- বেবিচকের ফ্লাইট সেফটি পরিচালককে প্রত্যাহার
তিন দিন আগেও যে প্রতিষ্ঠানটির শ্রেণিকক্ষ থেকে শুরু করে প্রতিটি কোণ কোমলমতি শিশুদের কলকাকলিতে মুখরিত থাকত শব্দ শোনা যেত সেই প্রতিষ্ঠানটি এখন আক্ষরিক অর্থেই মৃত্যুপুরীতে পরিণত। সোমবারের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার রেশ এখনো ভালোভাবেই ঘিরে রেখেছে পুরো প্রতিষ্ঠানটি। কোনো লম্বা ছুটি ছাড়া স্কুলের এমন সুনসান নীরবতা দেখা যায় না। মানুষের ভিড় এড়াতে গতকাল স্কুলটির প্রধান ফটক ও পেছনের ফটক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভেতরে সুনসান নীরবতা। নতুন কারো বোঝার উপায় নেই এখানে রাজধানীর নামকরা একটি স্কুল ও কলেজর অবস্থান। আঁচ করার উপায় নেই দেশ কাঁদানো হৃদয়বিদারক কোনো ঘটনা এখানে ঘটেছে। তবে বাইরে উৎসুক জনতার ভিড় দেখা গেছে গতকালও। সরেজমিন স্কুলের বাইরে থেকে দেখা গেল ভেতরের পুরো মাঠ খালি। চার দিকে পিনপতন নীরবতা। কয়েকজন শিক্ষকের দেখা মিললেও আশপাশে নেই কোনো শিক্ষার্থী। যুদ্ধবিমানের আঘাতে যে ভবনটিতে দুর্ঘটনা ঘটে, সেই ভবনের ভেতর এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে শিশুশিক্ষার্থীদের প্রিয় বই-খাতা, ব্যাগ, কলম ও জুতা।
প্রতিষ্ঠানটির সামনে গেটের বাইরের রাস্তাজুড়ে অবস্থান করছিলেন আশপাশের কিছু অভিভাবক, উৎসুক জনতা ও গণমাধ্যমকর্মীরা। খুব সকালে একটু ফাঁকা থাকলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন বয়সী মানুষ জড়ো হন। কেউ মোবাইলফোনে ছবি তোলেন, কেউ ভিডিও করেন। গণমাধ্যমের ক্যামেরাগুলো স্থির হয়ে আছে তালাবদ্ধ সেই গেটের দিকে। মাঝে মধ্যে ভেতর থেকে কেউ বের হলে ছুটে যান ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন।
গত সোমবার বেলা ১টা ১৩ মিনিটে রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এম হায়দার আলী ভবনের নিচতলায় বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান আছড়ে পড়ে। বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার সাথে সাথে আগুন লেগে ছড়িয়ে যায় চতুর্দিকে। স্কুল ছুটির একটু পরে যখন সবাই বাড়ি ফেরা শুরু করেছিল ঠিক তখনই ঘটে এই দুর্ঘটনা। যারা বের হয়ে গিয়েছিল তারা বেঁচে গেছেন। যেসব কোমলমতি শিশুশিক্ষার্থী, শিক্ষক তখনো বের হতে পারেননি তারাই দুর্ঘটনার শিকার হন। আগুনের লেলিহান শিখা আর উত্তাপে ঝলসে যায় অনেকের শরীর। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় ২০ জন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এরপর নানা হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দগ্ধ শরীরের যন্ত্রণা নিয়ে গতকাল বিকেল পর্যন্ত ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র বা আইসিইউতে মৃত্যুর মুখোমুখি অবস্থায় আছেন আরো অনেকে। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ দেখে শোকের ছায়া নেমে আসে দেশজুড়ে। শিশুদের এমন অসহায় ও মর্মান্তিক মৃত্যু দেশ-বিদেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয় নাড়া দিয়ে গেছে।
এ দিকে পুড়ে অঙ্গার হওয়া ছয় লাশের নমুনা সংগ্রহ করেছে পুলিশের অপরাধ বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক বিভাগ। এই হতভাগা ছয়জনের লাশের দাবিদার হয়ে এসেছেন ১১ জোড়া স্বজন। গতকাল পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রী ২২ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিআইডির কর্মকর্তা শম্পা। তবে কারো নাম প্রকাশ করেননি তিনি।
আরো ১ শিশুর মৃত্যু : রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় আরো এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩২ জনে দাঁড়াল। মঙ্গলবার রাত পৌনে ১টার দিকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে শিশু আরিয়া নাশরাফ নাফিকে (৯) মৃত ঘোষণা করেন আবাসিক সার্জন ডা: শাওন বিন রহমান। তিনি জানান, নাফির শরীরের ৯৫ শতাংশ দগ্ধ ছিল। এর আগে সোমবার রাতে মারা যায় নাফির বোন নাজিয়া তাবাসসুম নিঝুম (১৩)। নাফি মাইলস্টোন স্কুলে তৃতীয় শ্রেণী ও বোন নিঝুম ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ত। তাদের গ্রামের বাড়ি ভোলার দৌলতখান উপজেলার জয়নগর গ্রামে। বাবার নাম আশরাফুল ইসলাম নীরব। তারা তুরাগ থানাধীন কামারপাড়া এলাকায় থাকতেন।
স্কুলের পক্ষ থেকে কমিটি গঠন : যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় হতাহতদের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ এবং আহত, নিহত ও নিখোঁজদের নাম-ঠিকানাসহ তালিকা তৈরি করতে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলমকে সভাপতি করে গঠিত এই কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- উপাধ্যক্ষ (প্রশাসন) মো: মাসুদ আলম, প্রধান শিক্ষিকা খাদিজা আক্তার, কো-অর্ডিনেটর লুৎফুন্নেসা লোপা, অভিভাবক প্রতিনিধি মনিরুজ্জামান মোল্লা (শিক্ষার্থী: যাইমা জাহান, চতুর্থ শ্রেণী), এবং দ্বাদশ শ্রেণীর দুই শিক্ষার্থী- মারুফ বিন জিয়াউর রহমান ও মো: তাসনিম ভূঁইয়া প্রতিক। কমিটিকে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সরাসরি ঘটনাস্থল পরিদর্শন, সংশ্লিষ্ট পরিবারদের সাথে যোগাযোগ এবং নিশ্চিত তথ্য যাচাই করে তালিকা প্রস্তুত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
রোববার পর্যন্ত মাইলস্টোনের সব কার্যক্রম বন্ধ: মাইলস্টোন স্কুলের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম আগামী রোববার পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। স্কুল খোলার তারিখ পরবর্তীতে জানানো হবে। মৃতের সংখ্যা নিয়ে যা শোনা যায়, তা সত্য নয়, তবে তদন্ত কমিটি কাজ করছে। গতকাল মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক সাইফুল ইসলাম এসব তথ্য জানান।
বেবিচকের ফ্লাইট সেফটি পরিচালককে প্রত্যাহার : বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশন বিভাগের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো: আহসান হাবীবকে প্রত্যাহার করে সশস্ত্রবাহিনী বিভাগে ন্যস্ত করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আহসান হাবীবকে পদ থেকে সরিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। এজন্য তার চাকরি সশস্ত্রবাহিনী বিভাগে ন্যস্ত করা হয়েছে। অপর দিকে বেবিচকের ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশন বিভাগের নতুন পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো: মনিরুল ইসলামকে। তার চাকরি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়েছে।
খালেদ / পোস্টকার্ড ;