চট্টগ্রাম মহানগরে সরকারি-বেসরকারি ৯৯টি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মধ্যে ৯৬টিরই নেই নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এ তালিকায় রয়েছে নগরবাসীর চিকিৎসার সর্বশেষ ভরসাস্থল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালও। অথচ হাসপাতালে তরল বর্জ্য পরিশোধনের জন্য ইটিপি (এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট), ডব্লিউটিপি (ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট), এসটিপি (স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) থাকা বাধ্যতামূলক। নিজস্ব বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থা না থাকায় হাসপাতালগুলোর ক্ষতিকর চিকিৎসা বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নগরীর খোলা ডাস্টবিনগুলোতে। যার ফলে চরম দূষণের কবলে পড়ছে নগরীর পরিবেশ। আর আশঙ্কাজনক হারে ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন রোগ। তার ওপর সাম্প্রতিক ডেঙ্গুর প্রকোপের মাঝে চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে যত্রতত্র ফেলা এসব চিকিৎসা বর্জ্য। নগরবাসীর ক্ষোভ, রোগমুক্তির প্রতিষ্ঠানগুলোই নগরবাসীর মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে রোগ।
হাসপাতালে উৎপাদিত তরল বর্জ্য পরিশোধন করা হচ্ছে কীভাবে জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে সব মিলিয়ে প্রতিদিন আনুমানিক ৫-৭ টন বর্জ্য তৈরি হয়। কিন্তু আমাদের হাসপাতালে ইটিপি নেই। তাই সিটি করপোরেশনকে বর্জ্য দেওয়া হয়, তারা হালিশহরে নিয়ে যায়। আর তরল বর্জ্য দেওয়া হয় সেবা সংস্থা নামে একটি কোম্পানিকে। সব মেডিকেল বর্জ্য ডিসপোজাল করে এই সেবা সংস্থা।’
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালের জন্য যে সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (এসটিপি), এটা আসলে বিশাল ব্যাপার। এটা হাসপাতাল তৈরি করার সময় না থাকলে পরে করা মুশকিল হয়ে যায়। এ হাসপাতাল তো করা হয়েছে ১৯৯৭ সালে, এ কারণে এটা নেই।
সূত্র জানায়, চমেক হাসপাতালের বর্জ্য মজুদকরণ কক্ষে চারজন বর্জ্যকর্মী কাজ করেন। তারা প্রতিদিন বিভিন্ন ওয়ার্ডের আয়া ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাছ থেকে কঠিন ও তরল বর্জ্য সংগ্রহ করে কন্টেইনারে ভরেন। বিশেষ করে কাগজ, টিস্যু, প্যাকেট, প্যাথলজিক্যাল নমুনা, ব্যবহৃত রক্তমাখা গজ, ব্যান্ডেজ, মোজা, ন্যাকড়া, রক্ত, দেহরস, সিরামসহ সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন বর্জ্য কন্টেইনারে বোঝাই করেন বর্জ্যকর্মীরা। এ কাজে কোনোরকম সুরক্ষাসামগ্রী যেমন পিপিই, হ্যান্ড গ্লাভস, মাস্ক, স্যানিটাইজার, হেলমেট, জুতা ব্যবহার করছেন না তারা।
সরেজমিন চমেক হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালের বর্জ্য মজুদকরণ কক্ষের বাইরে এক পাশে কিছু বর্জ্য আলাদাভাবে ফেলে রাখা হয়েছে। সেখানে প্লাস্টিক, পলিথিন ব্যাগ, পানির বোতল, কাগজপত্র, স্যালাইন ব্যাগ, ওষুধের প্যাকেটসহ নানারকম বর্জ্য রয়েছে। আবার অন্যপাশে আরও কয়েকটি বস্তা ভর্তি ওষুধের শিশি-বোতল আলাদাভাবে রাখতে দেখা যায়।
এসব এখানে কেন আলাদাভাবে রাখা হয়েছে জানতে চাইলে বর্জ্যকর্মী রেজাউল হক বলেন, ‘এগুলো আমরা আলাদা করে রেখেছি। এসব বাইরে বিক্রি করে কিছু টাকা পাই।’ এ সময় বর্জ্যকর্মী ইমরুল বলেন, ‘আমরা কন্টেইনারে সব বর্জ্য লোড করে দিই। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬-৭টায় গাড়ি এসে তিন শতাধিক ড্রামে তরল ময়লা নিয়ে যায়। আর শুকনো ময়লা নিয়ে যায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) গাড়ি। চসিকের গাড়ি প্রতিদিন ৮ ড্রাম ময়লা নিয়ে যায়। ময়লাগুলো তারা আরেফিননগর পাহাড়ে ফেলে দেয়।’
ইমরুলের কথার সূত্র ধরে সরেজমিন নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার আরেফিননগর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড ঘেঁষে সমতল থেকে ২০০-৩০০ ফুট উচ্চতার কয়েকটি বর্জ্যরে পাহাড়। এখানে চসিকের গাড়ি থেকে নগরের সব ময়লা ফেলা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি বর্জ্যরে পাহাড়ে আগুন জ্বলছে। আর একটিতে দফায় দফায় ফেলা হচ্ছে নগরের সব ময়লা। এখানেই নগরীর অন্যান্য গৃহস্থালী বর্জ্যরে সঙ্গে ফেলে দেওয়া হচ্ছে মেডিকেল বর্জ্য।
শুধু চমেক হাসপাতাল নয়, নগরীর সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব হাসপাতালেরই তরল ও কঠিন বর্জ্য প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এসব বর্জ্য রোদে শুকাচ্ছে, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে, মিশে যাচ্ছে পানিতে।
নগরীর ফয়’স লেক এলাকায় অবস্থিত বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতালের (ইউএসটিসি) তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে পাশের লেকে। আর এ জন্য পরিবেশ অধিদফতর প্রতিষ্ঠানটিকে ৪৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করেছে।
সরেজমিন হালিশহরের টিজি কলোনি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বেশ বড় বড় কয়েকটি বর্জ্যরে পাহাড়। চতুর্দিকে উৎকট গন্ধ। সেখানে বর্জ্য ঘাঁটছেন একদল নিম্নআয়ের মানুষ। চিকিৎসা বর্জ্য থেকে প্রথম সংক্রমিত হচ্ছেন এরাই। এ ছাড়া কয়েকজন লোককে দেখা যায় কুড়িয়ে সংগ্রহ করা এসব বর্জ্য পণ্যের বস্তা জমা নিচ্ছেন। পরিচয় জানতে চাইলে তারা জানান, তারা সবাই বর্জ্য ব্যবসায়ী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মো. ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, হালিশহরের আনন্দবাজারে যে ইনসিরেটর প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে তা কেবল হাসপাতালের কঠিন বর্জ্য পোড়ানোর জন্য, তরল বর্জ্যরে জন্য নয়। আইন অনুযায়ী, তরল বর্জ্যকে ইটিপির মাধ্যমে পরিশোধন করে ফেলতে হবে। কিন্তু যেভাবে সেখানে তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে তাতে বিভিন্ন জটিল রোগে সংক্রমিত হবেন বর্জ্য ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের নজরদারি প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।
হাসপাতালের তরল বর্জ্য প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ওয়াজেদ চৌধুরী বলেন, ‘ইদানীং আমাদের রোগ অনেক বেড়ে গেছে। তরল বর্জ্য এভাবে ফেলে দেওয়ায় পরিবেশ চরমভাবে দূষিত হচ্ছে। ফলে প্রায়ই মারাত্মক রোগবালাই ছড়াচ্ছে। ময়লার পাহাড় থেকে বাতাসের মাধ্যমে রোগ ছড়াচ্ছে। আর বৃষ্টির সময় বর্জ্যগুলো ধুয়ে নগরে ছড়িয়ে পড়ছে, নদীতে যাচ্ছে। আবার সেই নদী থেকে আমরা পানি ব্যবহার করছি। পরিবেশ অধিদফতর ও সিটি করপোরেশন যদি জোরালো ব্যবস্থা না নেয়, তা হলে তো আমাদের ঝুঁকি আরও বাড়বে।’
যোগাযোগ করা হলে পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম মহানগরের উপ-পরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক বলেন, বেশ কয়েকবার হাসপাতালগুলোকে নোটিস করা হয়েছে। যেসব হাসপাতাল ইটিপি ডিজাইন সাবমিট করবে না, তাদের পরিবেশ ছাড়পত্র আমরা নবায়ন করছি না। চমেক হাসপাতালের পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। আমরা তাদের বেশ কয়েকবার চিঠি দিয়েছি। তারা ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছে।
খালেদ / পোস্টকার্ড ;