সীমা গ্রুপের মালিককে কোমরে দড়ি, নেট দুনিয়ায় নিন্দার ঝড়

বিশেষ প্রতিবেদক।।
সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় মঙ্গলবার (১৪ মার্চ) সন্ধ্যায় নগরীর জিইসি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক পারভেজ উদ্দিন সান্টু।
শিল্প পুলিশ বিস্ফোরণের ঘটনায় যে মামলায় তাকে আদালতে নিয়েছে ওই মামলার বাদীসহ অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের ঘটনায় সাতজনের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ১০ লক্ষ টাকা করে দেয়া হয়েছে। সরকারি নিয়ম অনুসারে দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকরা ক্ষতিপূরণ দুই লক্ষ টাকা পাওয়ার নীতিমালা থাকলেও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের নির্দেশে মালিকপক্ষ ১০ লক্ষ টাকা করে নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন।
বুধবার সকালে কোমরে দড়ি বাঁধা অবস্থায় সান্টুকে আদালতে তোলার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তেই নিন্দার ঝড় উঠে। ছবিটি রীতিমতো ‘টক অব দ্য চট্টগ্রামে’ পরিণত হয়।
ফেসবুকে পারভেজ উদ্দিন সান্টুর প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে একের পর এক পোস্ট দিতে থাকেন শিক্ষক, আইনজীবী, সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যমকর্মীসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। সবারই এক কথা, অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণে ৭ জন নিহত হওয়ার পর যদি মালিককে গ্রেপ্তার করে কোমরে দড়ি বাঁধা হয় তাহলে প্রশাসনের যারা তদারকি করেননি, তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না কেন?
চট্টগ্রামের একাধিক শিল্পপতি নিজেদের ফেসবুক পেজে এই ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে দোষী পুলিশ সদস্যদের বিচার দাবি করেন।
কৃষ্ণ চন্দ্র দাশ নামে একজন লিখেছেন, ‘কোমরে এ দড়ি মানে দেশের হাজারো শিল্প প্রতিষ্ঠানের কোমরে দড়ি। তিনি একজন উদ্যোক্তা। এ হিসেবে হাজারো উদ্যোক্তার কোমরে দড়ি। যেহেতু তিনি মামলায় এজাহারনামীয় আসামি, তাকে দাগি আসামির মতো দড়ি বেঁধে না নিয়ে ভিন্নভাবে নেয়া যেত।’
সরওয়ার্দী নামক একজন লিখেছেন, ‘করোনা সময় যখন মানুষ অক্সিজেনের অভাবে মরে যাচ্ছে, তখন এই মানুষটা বিনামূল্যে অক্সিজেন দিয়ে মানুষের পাশে ছিলেন। আমি বলছি না তার দোষ নেই, তাদের ভুলের কারণে হয়ত এমন দুর্ঘটনা হয়েছে, বিপরীতে ক্ষমা চেয়েছেন তারা। আইন অনুযায়ী দুই লাখ টাকার পাশাপাশি আরো আট লাখসহ মোট ১০ লাখ টাকা করে নিহত পরিবারের হাতে তুলে দেন ও আহতদের যাবতীয় চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করেন। ঘটনার পাঁচ দিনের মধ্যে সব কিছু দিয়ে দেয়ার পরেও তাকে জেলে যেতে হবে কেন? আগে একটি কন্টেইনার ডিপোতে ৫১ জন নিহত হওয়ার পরেও তাদের কেন জেলে নেয়া হল না?’
নুরুল হুদা নামে একজন মন্তব্য করেন, ‘সান্টু সাহেব সীতাকুণ্ড থেকে এমপি হতে চেয়েছিলেন। তাই এ প্রতিহিংসা।’
এসব পোস্টে করোনাকালীন পারভেজ উদ্দিন সান্টুর বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবার বিষয়টি বারবার ওঠে এসেছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীরা বলছেন, করোনাকালীন সময়ে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের মালিক সান্টু বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা দিয়েছিলেন। জাতির দুর্দিনে তিনি পাশে দাঁড়িয়েছিলেন৷ আর সেই মানুষটির প্রতি এ কেমন আচরণ?
সান্টুকে গ্রেপ্তারের তীব্র নিন্দা জানিয়ে সীতাকুণ্ডের নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সদস্য সচিব গিয়াস উদ্দিন তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বিএম ডিপো নামক ভাসুরের কথা মুখে আনলে পাপ, আর সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের ৯০ শতাংশ শ্রমিক সীতাকুণ্ডের। এটাই তার অপরাধ। তাই ওকেই ধরতে হবে।’
সাহাব আজিজ নামে একজন লিখেছেন, ‘করোনাকালীন সময়ে আমার মা ছিল ডায়ালাইসিস রোগী। হঠাৎ শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় খালি সিলিন্ডার নিয়ে দৌড়াদৌড়ি ও চারিদিকে ফোন করেও অক্সিজেন রিফিল করতে পারছিলাম না। হঠাৎ উনার (সান্টু) ফেসবুক পোস্ট চোখে পড়ল। ফোন করতেই সাথে সাথে সাড়া পেলাম। ফ্যাক্টরিতে গিয়ে রিফিল করে নিয়ে আসলাম কোনো টাকা নেননি। সত্যিই পারভেজ ভাই খুব ভালো মানুষ। আপনারা ওনার সম্মানহানি করবেন না। ওনাকে নিঃশর্তে মুক্তি দিন।’
মহিউদ্দিন বাবলু নামে একজন রাজনীতিবিদ লিখেছেন, ‘দুর্ঘটনা হতেই পারে। সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের মালিক দেশের একজন শিল্পপতি ও সম্মানিত নাগরিক। তাকে এভাবে কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে তোলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। এটি অত্যন্ত অমানবিক এবং দুঃখজনক। যা শিল্প পুলিশের বাড়াবাড়ি। একটি বিশেষ মহল দ্বারা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার ষড়যন্ত্র।’
এম কে শীবলী নামে একজন লিখেছেন, ‘ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়েও গ্রেপ্তার হতে হলো সীমা গ্রুপের পরিচালককে। অথচ বিএম ডিপোতে নিহতের সংখ্যা দশগুণ বেশি হলেও গ্রেপ্তার হননি সেটির মালিক।’
আনিসুল হক নামে একজন রাজনীতিবিদ লিখেছেন, ‘সীমা অক্সিজেনের মালিক যা করেছেন বিএম ডিপোর মালিক তাও করলেন না। অথচ তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। এটা কি সমান বিচার হলো? সীতাকুণ্ডের মানুষ এটির প্রতিবাদ করুন।’
ওমকার নন্দী নামে একজন লিখেছেন, ‘দুনিয়াতে ভালো মানুষের দাম নেই। ক্ষতিপূরণ দিলো। ক্ষমাও চাইলো। এরপরও ধরে নিয়ে গেলো। দুঃখজনক।’
সেলিমুল্লাহ সেলিম লিখেছেন, ‘সান্টু সাহেবের উপর হয়তো সীতাকুণ্ডের কারো বদনজর পড়েছে।’
ফজলে করিম চৌধুরী নিউটন লিখেছেন, ‘সীমা অক্সিজেন প্লান্টের মালিক পারভেজ উদ্দিন সান্টুকে গ্রেপ্তার পরবর্তী কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে তোলার তীব্র নিন্দা জানাই। এটি সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার ষড়যন্ত্র।’
ফখরুল ইসলাম সোহেল নামে একজন স্বেচ্ছাসেবক লিখেছেন, ‘করোনাকালে মানুষের ঘরে ঘরে যে বিনামূল্যের অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে নিজে গিয়েছিলাম, সেই সিলিন্ডার দানকারী পারভেজ উদ্দিন সান্টু ভাইকে কোমরে দড়ি বেঁধে চোর-ডাকাতের মতো আদালতে তোলা, এটি কি শোভন হলো? খুবই দুঃখ ও কষ্ট পেলাম।’
চট্টগ্রাম চেম্বার প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম বিষয়টি নিয়ে সরাসরি পুলিশের আইজিকে ফোন করেন। তিনি বিষয়টিকে দুঃখজনক বলে উল্লেখ করে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানান এবং দোষী পুলিশ সদস্যদের বিচার দাবি করেন।
চট্টগ্রাম মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. আবদুর রশীদ বাংলানিউজকে বলেন, ব্যবসায়ী পারভেজ উদ্দীনকে হাতকড়া ও কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে হাজির করাটা অন্যায় ও বেআইনি আচরণ করেছেন। নিরাপত্তার জন্য যা করার সেটা করবে কিন্তু একজন ব্যবসায়ীকে হাতে হাতকড়া ও কোমরে দড়ি বেঁধে দেওয়া কাজটা ঠিক হয়নি। যারা এই কাজ করেছেন তারা ঠিক করেনি।
গত তিনদিন আগে সীমা অক্সিজেন প্লান্টের মালিক পারভেজ উদ্দিন সান্টু তার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে একটি পোস্ট দিয়ে নিহত, আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত সকলের কাছে ক্ষমা চান, নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। একইসাথে তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ৯০ শতাংশ শ্রমিক সীতাকুণ্ডের জানিয়ে সীতাকুণ্ডের সাথে ভাতৃত্ব বন্ধন ও ভালোবাসার আত্মিক সম্পর্কের কথা তুলে ধরেন।
তিনি ওই পোস্টে বলেন, কেবল মহান আল্লাহতায়ালাই ভালো জানেন কীভাবে এতো বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল। কোন পিতা যেমন ইচ্ছে করে তার সন্তানের মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করেন না। ঠিক তেমনি আমরাও ইচ্ছে করে আমাদের হাজার মানুষের প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইনি। তাই আমরা মেনে নিয়েছি এটি একটি অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা।
এ বিষয়ে সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘দড়ি দিয়ে বাঁধার বিষয়টি জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নজরে আনা হয়েছে। তিনি শিল্প পুলিশকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছেন। শিল্প পুলিশের কাছ থেকে আমরা জেনেছি, যারা এ কাজটি করেছেন তাদেরকে ইতিমধ্যে শোকজ করা হয়েছে, বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
এ বিষয়ে মানবাধিকার আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘কারাবন্দীদেরও মানবাধিকার বলে কথা আছে। তিনি গরীব মানুষ হোক আর শিল্পপতি হোক। কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে তোলাকে সভ্যতার নির্দশন মনে করি না। অর্ধশতাধিক মানুষ পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার পরও বিএম কন্টেইনার ডিপোর মালিককে যেখানে আটক করা হয়নি, সেখানে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের মালিককে আটকের পর কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে তোলা হয়েছে। আমি বলবো, এখানে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্য হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, গত ৪ মার্চ বিকাল সাড়ে চারটায় সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী ইউনিয়নের কদমরসুলস্থ সীমা অক্সিজেন প্লান্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে ৫ জন নিহত হন এবং প্ল্যাট উড়ে গিয়ে আঘাতে আরও দুইজন নিহত হন। গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত ২৫ জন।
খালেদ / পোস্টকার্ড ;