সীতাকুণ্ডে পানি চলাচলের পথ ও কৃষি জমি দখল করে রাস্তা নির্মাণ, প্রবাসী স্ত্রীর মামলা

পোস্টকার্ড ডেস্ক ।।
সরকারি জায়গার উপর থাকা গ্রামের পানি চলাচলের পথ বন্ধ করে ও ফসলি জমি ভরাট করে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক মহাদেবপুরে ফ্ল্যাট-প্লটের রাস্তা নির্মাণ করছে একটি প্রভাবশালী চক্র ।
ইতিমধ্যে তাঁরা রাতের অন্ধকারে ট্রাকে ট্রাকে বালু ও ইটের টুকরো ফেলে ৫০ ফুটের পানি চলাচলের ওই পথটি সম্পূর্ণ ভরাট করে ফেলেছে চক্রটি। শুধু তাই নয়, স্থানীয় এক প্রবাসীর সাড়ে উনিশ শতক কৃষি জমিও ভরাট করে ফেলেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পানি চলাচলের পথ বন্ধ করে রাস্তা নির্মাণের ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন স্থানীয় কৃষক, ব্যবসায়ীসহ বাসিন্দারা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মহাসড়কের পূর্ব পাশের ছড়া আকৃতির জায়গাটি সরকারি হলেও আশেপাশের কয়েক গ্রামের পানি চলাচলের একমাত্র পথ। সম্প্রতি জমি ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী একটি চক্র প্লট নির্মাণের জন্য পানি চলাচলের পথটির পূর্ব পাশের কিছু কৃষি জমি কেনাবেচা করে। আর ক্রেতাকে রাস্তা বুঝিয়ে দিতে তারা সরকারি জায়গায় থাকা পানি চলাচলের পথ দখল করে নিচ্ছে। রাতারাতি ভরাট করে ফেলছে। এতে বর্ষাকালে ওই এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিবে। একইসাথে কৃষি জমির সেচ ব্যবস্থাও হুমকিতে পড়বে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সীতাকুণ্ড পৌরসভার মহাদেবপুর ইকোপার্ক এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পূর্ব পাশে অবস্থিত সাব প্লাস সিএনজি স্টেশনের সামনের অংশ ঘেঁষে একটি প্রশস্ত ছড়া সোজা দক্ষিণে চলে গেছে। যা দেড় কিলোমিটার দূরের একটি শাখা খালে গিয়ে মিলিত হয়েছে। এ ছড়াটি দিয়ে পৌরসভার মহাদেবপুর, ফকিরহাট, ঢালিপাড়া, সিরাজ ভূঁইয়া রাস্তার মাথা, দক্ষিণ রহমত নগর, বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কসহ দুটি হিন্দুপাড়ার পানি চলাচল করে। ছড়াটি সড়ক ও জনপদের সরকারি সম্পত্তি। কিন্তু গত কয়েকদিন আগে সেখানে উঁচুভাবে বালু ও ইটের কণা ফেলে ভরাট করে ফেলেছে একটি চক্র। ভরাটের ফলে পুরো পানির পথটি বন্ধ হয়ে গেছে। একইসাথে আশেপাশের কৃষি জমিও ভরাট করে ফেলা হচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, রাস্তাটি তৈরির জন্য মো. শাহাজাহান নামে এক প্রবাসীর ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ কৃষি জমি জোরপূর্বক ভরাট করছে ওই চক্র। জায়গাটি ছেড়ে দিতে তারা রীতিমতো প্রবাসীর স্ত্রীকে বাড়িতে গিয়ে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন, হুমকি দিচ্ছেন। বাধ্য হয়ে প্রবাসীর স্ত্রী হোসনে আরা বেগম গত ১১ মে চট্টগ্রামের (উত্তর) অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৫ জনকে বিবাদী করে একটি মামলা দায়ের করেছেন। এরা হলেন, সীতাকুণ্ডের পূর্ব মুরাদপুর ঢালিপাড়া এলাকার মৃত মকবুল মিস্ত্রীর ছেলে হোসেন নিজামী (৬৫), হোসনের নিজামীর ছেলে আলাউদ্দিন, গিয়াসউদ্দিন, সোহাগ উদ্দিন ও একই এলাকার বাসিন্দা মো. জাহিদ।
হোসেনে আরা বেগমের অভিযোগ, গত ৯ মে রাতে ১টায় বিবাদীরা তার স্বামীর ক্রয়কৃত জমিতে ট্রাকে করে মাটি ফেলতে থাকেন। এতে তাদের জমিটি ভরাট হয়ে যায়। এর আগে ওই চক্রের সদস্য জাহিদ তাকে জায়গাটি ছেড়ে দিতে বলেন। একইসাথে তার স্বামীকে ফোন করে এমনভাবে বুঝাতে বলেন যেন তিনি জায়গা নিয়ে মাথা না ঘামান৷ অন্যথায় তাদেরকে ঘুমে রেখে জোরপূর্বক রাস্তা নির্মাণ করা হবে বলেও হুমকি দেন জাহিদ।
হোসনে আরা বেগম আরও বলেন, মহাদেবপুর মৌজার ১৯.৫০ শতাংশের কৃষি জমিটি ১৯৯৮ সালের রেজিস্ট্রি দলিলমূলে তার স্বামী মো. শাহাজাহানের নামে রেকর্ডভুক্ত। কিন্তু তার স্বামী দীর্ঘ দিন প্রবাসে থাকার সুযোগে ভূমিদস্যু চক্র জমিটি দখলের পাঁয়তারা করে আসছে। তারই অংশ হিসেবে তারা জোরপূর্বক মাটি ও বালু ফেলে ভরাট করে ফেলছে।
অন্যদিকে এলাকার পানি চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ক্ষোভ প্রকাশ করে কৃষক মো. মুছা (৬০) বলেন, মহাসড়কের পাশের পানি চলাচলের পথটি কয়েক গ্রামের পানি নিষ্কাশনের পথ। বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢলের পানি ইকোপার্ক ছড়া দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এই পথে নামে। এরপর শাখা খাল হয়ে সরাসরি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। এতে বন্যা থেকে রেহাই পান গ্রামবাসী। তাছাড়া শুস্ক মৌসুমে সরু এ খালটি হয়ে ওঠে আশেপাশের পঞ্চাশ একর কৃষি জমির সেচের একমাত্র ভরসা। তিনি আরও বলেন, জনপ্রতিনিধিরা এসব বিষয়ে অবগত হয়েও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। তারা সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ইলিয়াছ হোসেন বলেন, ভূমিদস্যু চক্র নিজেদের প্লটের রাস্তা বানাতে গ্রামবাসীকে ডুবিয়ে মারার পরিকল্পনা করছে। আমরা ইউএনও ও এসিল্যাণ্ডকে অভিযোগ দিয়েছি। অবিলম্বে আমাদের পানি চলাচলের পথ খুলে দিতে হবে। সরকারি জায়গায় থাকা পানি চলাচলের পথ দখল হতে দিব না আমরা।
একই কথা বলেন স্থানীয় দুইজন জনপ্রতিনিধিও। মুরাদপুর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য কামাল উদ্দিন বলেন, আশেপাশের সব গ্রামে পানি ওই ছড়া দিয়ে প্রবাহিত হয়। ভরাটের ফলে পানি চলাচলের কোন পথ থাকবে না। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। সীতাকুণ্ড পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দিদারুল আলম এ্যাপোলো বলেন, ইকোপার্ক ছড়ার পানি এ পথ দিয়েই প্রবাহিত হয়। স্থানীয় বাড়িঘর, দোকানপাট, ফিলিং স্টেশনসহ প্রায় সব এলাকার পানি চলাচলের একমাত্র পথ। আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ জায়গাটি পরিদর্শন করেছি। পানি চলাচলের পথ দখল করে রাস্তা তৈরির কোনো সুযোগ নেই।
\জানতে চাইলে সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলম বলেন, মধ্য রাতে পানি চলাচলের পথ ভরাট করার খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাহাদাত হোসেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন৷ তিনি ভরাট কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। উভয়পক্ষকে ডেকে পাঠিয়েছেন। পানি চলাচলের পথ বন্ধের কোনো সুযোগ নেই। দ্রুত মাটিগুলো অপসারণ করে পানি চলাচলের পথটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
জানতে চাইলে অভিযুক্ত মো. আলাউদ্দিন বলেন, আপনি আমাকে কেন ফোন দিয়েছেন? এখানে সাংবাদিকদের কাজ কি? এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তো জায়গাটি আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। যে কিনে নিয়েছে সে দখল করেছে হয়তো। এসময় কার কাছে জমিটি বিক্রি করেছেন জানতে চাইলে তিনি ইতস্তত বোধ করেন। এমনকি ক্রেতার নামও জানাতে পারেননি।
খালেদ / পোস্টকার্ড ;