মিরসরাইয়ের মেলখুম পাহাড়ি ট্রেইল পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, বসবাস করেন জ্বীন!
বিশেষ প্রতিবেদক।।
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আঁধার মেলখুম পাহাড়ি ট্রেইল। গহীন পাহাড়ের এই ট্রেইলটি নিয়ে রহস্যের যেন শেষ নেই। কী আছে সেখানে? কেন এতোটা কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয় সেখানে যেতে? কেন এতোটা আকর্ষণীয় এই ট্রেইল? সত্যিই কি সেখানে জ্বীনেরা বসবাস করেন? এমন সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গহীন পাহাড়ের আঁকাবাঁকা, অত্যন্ত সরু, বেশ পিচ্ছিল, গভীর খাদের ঝিরি, অন্ধকারাচ্ছন্ন, বিপদজনক সুউচ্চ পাহাড়ের কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে মেলখুমে বা মেলকুমে পৌঁছায় দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা পর্যটকরা।
কিন্তু দিনে দিনে সেখানে ঘটছে নানা অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা। প্রায়শ পর্যটকরা সেখানে আটকা পড়ছেন। ৯৯৯ এ কল করে জানাচ্ছেন হারিয়ে যাওয়ার কথা। দীর্ঘ ৭-৮ ঘন্টা অভিযান চালিয়ে পুলিশকে পর্যটকদের উদ্ধার করতে হচ্ছে। আবার অনেকে সেখান থেকে ফেরার পর শরীরে জ্বীন আছর করছে। যাদের জীবনে নেমে আসছে এক দুর্বিষহ যন্ত্রণা। এবার মেলখুম ট্রেইলে পর্যটকদের প্রবেশ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সোমবার (১৫ মে) থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সেখানে প্রবেশ না করতে পর্যটকদের নিরুৎসাহিত করতে শুরু করেছে মিরসরাই রেঞ্জ বন বিভাগের কর্মকর্তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ বাজারের পূর্ব পাশের পাহাড়ের গহীন পাহাড়ে অবস্থিত মেলখুম ট্রেইল। মেলখুমে যেতে সমতল ভূমি থেকে আড়াই থেকে তিন কিলোমিটারের ঝিরি পথ পাড়ি দিতে হয়। যেতে সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘন্টা। এ পথটি অত্যন্ত বিপদজনক। মেলখুমে প্রবেশের পথটি আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা এ পথটি অত্যন্ত পিচ্ছিল, ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন, রয়েছে গভীর খাদও। সেখানে সূর্যের আলো পৌঁছে না।
স্থানীয়রা এটিকে মৃত্যুকূপ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এটির প্রবেশ পথের দুইপাশে অন্তত ২০০ ফুট উঁচু পাহাড় আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে আছে। চলার পথটি বেশ সরু। সেখানে একবার কেউ পড়ে গেলে বা আটকা পড়লে তাকে সহজে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। এছাড়াও মেলখুম কূপে দিনের বেলায় ঘন অন্ধকার থাকে। অত্যন্ত গভীর হওয়ায় কূপটি বেশ ভয়ানক।
স্থানীয়রা জানান, পাহাড়ি ছড়ায় মেল গাছের লতা কেটে দিলে মাছ মারা যেত। পরদিন সকালে সেই মাছ কুড়িয়ে নিত শিকারীরা। মেল গাছের লতায় থাকে বিশেষ ধরণের বিষ। ছড়ার পানিতে যতদূর এ বিষ ছড়িয়ে পড়ত ততদূর সব মাছ মারা যেত। এভাবেই জায়গাটির নাম মেলখুম বা মেলকুম হিসেবে পরিচিত পায়।
স্থানীয়ভাবে এ কূপটি নিয়ে লোকমুখে নানা কথা প্রচলিত রয়েছে। অনেকের মতে এখানে জ্বিনরা বসবাস করেন। কূপটিকে জ্বীনের আস্তানাও বলা হয়ে থাকে। বলা হয় যে সেখানে যাতায়াত করা মানুষদের উপর জ্বীনরা আছর করেন। পরবর্তীতে তাদের জীবনে দূর্বিষহ কষ্ট নেমে আসে। আছর করা জ্বীনরা সহজে গা ছাড়েন না। আবার অনেকের মতে মেলখুম কূপে মানুষ হারিয়ে যায়। এমন অনেকেই আছেন যাদেরকে আর পাওয়া যায়নি। তবে বাস্তবে ঘটে যাওয়া জ্বীন আছর করা ও হারিয়ে যাওয়ার কয়েকটি ঘটনা এসব কথার ভিত্তি মজবুত করে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মেলখুমে ঘুরতে এসে ভয়াবহ ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতির শিকার হওয়ার কথা একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন পর্যটক মো. রাকিব ও রাকিবুল হাসান।
তারা জানান, মেলখুমে গিয়ে তারা একাধিকবার অশরীরী আত্মার মতো কিছুর দেখা পেয়েছেন। তারা মানুষ সদৃশ্য এমন কিছু দেখেছেন যা তারা আজও ভুলতে পারছেন না। বেশ কয়েকবার সেটিকে ভাই বলে ডাক দিলেও কোন জবাব পাওয়া যায়নি৷ সেখানে গিয়ে তারা বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। ভয়ে তারা পুরো ট্রেইল অতিক্রম না করেই ফিরে আসেন। তারা যেখানে তাদের ব্যাগটি রেখেছিলেন ফেরার পথে দেখেন সেই ব্যাগটি অনেক দূরে কাদায় ছুঁড়ে মারা হয়েছে। তাদের মতে কেউ যদি চুরির উদ্দেশ্যে তাদের ব্যাগটি ধরে থাকেন তাহলে তা নিয়ে যাবেন নতুবা ব্যাগের মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নিবেন। কিন্তু তা না করে অত্যন্ত বাজেভাবে ব্যাগটিকে অনেক দূরে ছুঁড়ে মারা হয়েছে।
তারা আরও জানান, মেলখুম অত্যন্ত ভয়ানক, অন্ধকারাচ্ছন্ন। সেখানে সূর্যের আলো পৌঁছে না। বন্যপ্রাণীর আক্রমণের শিকার হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এসব ঘটনা তাদের ক্যামেরায় ধরা পড়েছে বলেও জানান তারা। ইসলাম ধর্মের মানুষ হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে মানুষের পাশাপাশি জ্বীনের বিচরণ রয়েছে। মেলখুম কূপে জ্বীন থাকাটা খুব অস্বাভাবিক কিছুও নয়।
তবে কেবল রাকিবরা নয়, মিরসরাইয়ের মেলখুম ট্রেইলে গিয়ে বিপদগ্রস্ত হয়েছেন আরও অনেক পর্যটক। এই ঈদুল ফিতরের ছুটিতে মেলখুমে ঘুরতে এসে আটকা পড়েন ৫ পর্যটক। পরে জোরারগঞ্জ থানা পুলিশ টানা ৮ ঘন্টা অভিযান চালিয়ে তাদেরকে উদ্ধার করে।
মিরসরাই বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা শাহ নেওয়াজ নওশাদ বলেন, মেলখুম ট্রেইল বিপদজনক বিধায় সেখানে পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাছাড়া সেখানে জ্বীনের অস্তিত্ব থাকার ব্যাপারে শোনা যাচ্ছে। অনেক পর্যটক সেখানে গিয়ে বিপদে পড়ছেন। ইতিমধ্যে আমরা মেলখুমের বিভিন্ন প্রবেশ পথে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি, সাইনবোর্ড টাঙিয়েছি।
‘পর্যটকদের বারবার সতর্ক করা হচ্ছে মেলখুমে না যেতে। গতকালও পাহাড়ে আমাদের নিরুৎসাহিতকরণ অভিযান অব্যাহত ছিল। এরপরও কিছু পর্যটক ভিন্ন পথ অবলম্বন করে মেলখুম ট্রেইলে পৌঁছে যাচ্ছেন৷ কেউ যদি সেখানে গিয়ে কোন বিপদে পড়েন তাহলে আমরা তার দায় নিব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু মেলখুম কোনো পর্যটন স্পট নয়, সেহেতু আমরা কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবো না। এটি একটি রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকা। এমনিতেই সেখানে দু’চারজন প্রবেশ করতে হলে অনুমতির প্রয়োজন আছে বলে জানান তিনি ।’
মনির / খালেদ / পোস্টকার্ড ;