সুখময় জীবনের স্বাদ আল্লাহর জিকিরে

সুখময় জীবনের স্বাদ আল্লাহর জিকিরে
মাওলানা শোয়াইব রিফাত ।।
" আল্লাহ " পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র ও বরকতময় নাম ! এ নামে যে স্বাদ ও আনন্দ রয়েছে, পৃথিবীর অন্য কিছুতে তা নেই। এ নামের জিকির ও স্মরণ এমন এক পরম শক্তি, যা দুর্বলকে সবল করে, মুমিনকে আনন্দিত করে, পার্থিব ও অপার্থিব এক মহাশক্তির পথে উপনীত করে। বান্দা যখন জিকির করে, তখন সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে সে সম্পর্ক স্থাপন করে।
 
জিকিরকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন। ফেরেশতাদের মজমায় আল্লাহ সে বান্দাকে স্মরণ করেন। আল্লাহর জিকির হচ্ছে ইবাদতের রূহ ও প্রাণ। আল্লাহর জিকিরকারী ব্যক্তির অন্তরে এ বিশ্বাস থাকে যে, জীবন ও জগতের সব কিছু আল্লাহর হুকুমেই হয় এবং আল্লাহর কোনো ফয়সালা বান্দার জন্য অশুভ নয়। আল্লাহর সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার মাঝেই বান্দার কল্যাণ ও সাফল্য।
 
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জিকির প্রসঙ্গে এত আলোচনা করেছেন, অন্য কোনো ইবাদত সম্পর্কে এমন বলেননি। কারণ আল্লাহর জিকির ও স্মরণ এমন এক বিষয়, যা মানুষকে সব ধরনের গুনাহ থেকে রক্ষা করে এবং শরিয়তের হুকুম মেনে চলতে সাহায্য করে। তা ছাড়া জিকির এত সহজ একটি আমল যে, এর জন্য আলাদা করে বেশি সময় ব্যয় করার কিংবা অন্যান্য কাজ স্থগিত রাখার প্রয়োজন হয় না। ব্যবসা-বাণিজ্য, হাঁটা-চলা, ভ্রমণ-শয়ন ইত্যাদি সব রকম কাজে ব্যস্ত থেকেও আল্লাহর জিকির করা যায়। এমন জিকিরকারীদের সম্পর্কেই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন ‘যারা আল্লাহর জিকির করে দাঁড়ানো অবস্থায়, বসা অবস্থায়, শায়িত অবস্থায় এবং আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে বলে, হে আমাদের রব! এসব আপনি অনর্থক সৃষ্টি করেননি।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৯৯)। জিকির ও জিকিরকারীর ফজিলত সম্পর্কে কিছু আলোচনা তুলে ধরা হলো।
 
আল্লাহর জিকির উত্তম আমল : হজরত আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) সাহাবাদের বললেন, আমি কি তোমাদের এমন একটি জিনিসের কথা বলব না, যা তোমাদের সব আমলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ; তোমাদের রবের কাছে সবচেয়ে পবিত্র; তোমাদের মর্যাদাকে আরও উঁচুতে উন্নতকারী; আল্লাহর রাস্তায় সোনা-রুপা খরচ করা থেকে এবং জিহাদের ময়দানে শত্রুর প্রাণ নেওয়া ও শত্রুর হাতে প্রাণ দেওয়া থেকেও উত্তম? সাহাবারা বললেন, অবশ্যই বলুন। তখন নবীজি বললেন, তা হলো আল্লাহর জিকির। (তিরমিজি : ৩৩৭৭; ইবনে মাজা : ৩৭৯০)
 
জিকিরকারীকে আল্লাহ স্মরণ করেন: যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির ও স্মরণ করে, আল্লাহ তায়ালাও সে ব্যক্তির কথা আলোচনা করেন। হাদিসে এসেছে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বান্দা আমার প্রতি যেমন ধারণা রাখে, আমি তার সঙ্গে তেমন ব্যবহারই করি। যখন সে আমাকে স্মরণ করে, আমি তার সঙ্গে থাকি। সে যদি আমাকে মনে মনে স্মরণ করে, আমিও তাকে মনে মনে স্মরণ করি। সে যদি কোনো মজলিসে আমার জিকির করে, তবে আমি তার চেয়ে উত্তম মজলিসে (ফেরেশতাদের মজলিসে) তার কথা আলোচনা করি।’ (বুখারি : ২/৭৪০৫; মুসলিম : ২৬৭৫)। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন ‘তোমরা আমার জিকির কর, আমি তোমাদের স্মরণ করব।’ (সুরা বাকারা : ১৫২)
 
গোনাহ মাফের ঘোষণা : জিকিরকারীর গোনাহ মাফ করে দেন আল্লাহ। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন কিছু মানুষ আল্লাহর জিকিরের জন্য একত্রিত হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিই একমাত্র উদ্দেশ্য হয় তখন আসমান থেকে একজন ঘোষক ঘোষণা করেন, তোমাদের মাফ করে দেওয়া হয়েছে এবং তোমাদের গোনাহসমূহ নেকিতে পরিণত হয়েছে।’ (মুসনাদে আহমদ : ৩/১৪২)
 
আরশের ছায়ায় আশ্রয় : হাশরের মাঠে সূর্য অনেক নিচে নেমে আসবে। মানুষ পেরেশান হয়ে ছটফট ও ছোটাছুটি করতে থাকবে। সেই কঠিন সময়ে আল্লাহর জিকিরকারীরা আল্লাহর আরশের শীতল ছায়ায় পরম আরামে আশ্রয় লাভ করবে। হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা সাত ব্যক্তিকে আরশের ছায়ায় স্থান দিবেন। তাদের মধ্যে এক শ্রেণি হচ্ছে ওই ব্যক্তি, যে একান্তে আল্লাহর জিকির করেছে এবং আল্লাহর স্মরণে চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হয়েছে।’ (বুখারি : ৬৪৭৯)
 
পৃথিবীতে জান্নাতের বাগান : পৃথিবীতে জিকিরের বৈঠক সবচেয়ে উত্তম। হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দুনিয়া ও দুনিয়ার সব বস্তু অভিশপ্ত, তবে আল্লাহর জিকির ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয় এবং আলেম ও তালেবে ইলম ছাড়া।’ (তিরমিজি : ২৩২২)। অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা যখন জান্নাতের বাগানের কাছ দিয়ে যাও, তখন সেখানে খুব বিচরণ কর। সাহাবারা বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! জান্নাতের বাগান কী? তিনি বললেন, জিকিরের মজলিসমূহ।’ (তিরমিজি : ৩৫১০)
 
জিকির না করার কারণে আফসোস : দুনিয়ার জীবন যারা আল্লাহর জিকির ছাড়া অতিবাহিত করেছে, জান্নাতে তারা আফসোস করতে থাকবে। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘জান্নাতে প্রবেশ করার পর জান্নাতবাসীরা দুনিয়ার কোনো জিনিসের জন্য আফসোস করবে না, শুধু ওই সময়ের জন্য আফসোস করবে, যা দুনিয়াতে আল্লাহর জিকির ছাড়া অতিবাহিত করেছে।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ : ১৬৭৪৬)
 
জিকিরকারীর উদাহরণ : যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির করে তার উদাহরণ হচ্ছে জীবিত ব্যক্তির মতো। কারণ তার সময়গুলো পরকালে সংরক্ষিত হচ্ছে। আর যে ব্যক্তি জিকির করে না তার উদাহরণ মৃত ব্যক্তির মতো। কারণ মৃত ব্যক্তি যেমন কোনো আমল বা কাজ করতে পারে না, তেমনি উদাসীন ব্যক্তির সময়গুলোও নিষ্ফল ও অসাড়। হাদিসে এসেছে, হজরত আবু মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে তার রবের জিকির করে আর যে করে না, তাদের উদাহরণ হচ্ছে জীবিত ও মৃত ব্যক্তির মতো। (অর্থাৎ যে আল্লাহকে স্মরণ করে সে যেন জীবিত। আর যে স্মরণ করে না সে যেন মৃত)।’ (বুখারি : ৬৪০৭)
 

সুতরাং প্রতি মুহূর্তেই খুব বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করা চাই। এতেই বান্দার সাফল্য ও কল্যাণ। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা অধিক পরিমাণে আল্লাহর জিকির ও স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলতা অর্জন কর।’ (সুরা আনফাল : ৪৫)