মামলার নথি গায়েব হচ্ছে হাইকোর্ট থেকে

হিরা তালুকদার ।।

মামলার নথি গায়েব হচ্ছে হাইকোর্ট থেকে
মামলার নথি গায়েব হচ্ছে হাইকোর্ট থেকে
সুপ্রিমকোর্টে নথি গায়েব নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু সম্প্রতি তা বেড়ে গেছে ব্যাপক হারে। এখন প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ মামলার নথি উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। এতে করে বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবী উভয়ই পড়ছে চরম বিপাকে। বিষয়টি প্রধান বিচারপতিসহ হাইকোর্টের একাধিক বেঞ্চের নজরেও আনা হয়েছে। লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের কাছে। তাতেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
সুপ্রিমকোর্টের বেশ কয়েকজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ‘নথি গায়েবের’ সঙ্গে এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততা আছে। 

ইচ্ছে করে নথি লুকিয়ে রেখে পরবর্তী সময়ে টাকা দিলে তা বের করে দেওয়া হয়। আর টাকা না দিলে সেই নথি ‘গায়েবই’ থেকে যায়। খুঁজে পাওয়া যায় না সেকশনেও। আইনজীবীদের মতে নথি গায়েবের মতো মারাত্মক অপরাধ প্রতিরোধ করতে পারে শুধু সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। তারা যদি জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেন তাহলে এ ধরনের ঘৃণ্য ঘটনা কমে আসতে বাধ্য।অনুসন্ধানে জানা গেছে, একটি ফৌজদারি মামলায় জাহিদুর রহমান নামের এক ব্যক্তির যাবজ্জীবন সাজা হয়। ২০১৮ সালে হাইকোর্ট থেকে ছয় মাসের জামিন নেন তিনি। পরে জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চে আবেদন করেন। যথারীতি তা চলতি বছরের মে মাসে কার্যতালিকায় আসে। কিন্তু নথি না আসায় জামিন শুনানি হয়নি। এরপর বেশ কয়েকবার আবেদনটি কার্যতালিকায় আসলেও মামলার নথি না আসায় শুনানি হয়নি। একইভাবে টাঙ্গাইলের মো. মজিবুর রহমানের চাকরি সংক্রান্ত একটি রিট মামলায় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রুল জারি করে তার পদে অন্য কাউকে নিয়োগে স্থগিতাদেশ দেন। ২০১৮ সালের সেই মামলায় গত জুনে রুলের চূড়ান্ত শুনানি করতে গেলে দেখা যায় মামলার নথি গায়েব। বেশ কয়েকবার মামলাটি শুনানির জন্য আসলেও নথি না আসায় শুনানি করা সম্ভব হয়নি।

উচ্চ আদালতে সাবেক এক মন্ত্রী ও এমপিসহ অনেক হাইপ্রোফাইল ব্যক্তির দুর্নীতির ফাইলও গায়েব হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় লোক পাঠাতে কারসাজির মাধ্যমে ১০ ব্যবসায়ীকে লাইসেন্স প্রদান সংক্রান্ত রিটের কাগজপত্র খুঁজতে গিয়ে অন্য মামলার নথি হারানোর বিষয়টি সামনে এসেছে। সংশ্লিষ্ট সেকশন থেকে ফাইল গায়েবের বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকে লিখিতভাবে আদালতের নজরে আনা হয়েছে। তবে এখনও এগুলোর সন্ধান না মেলায় মামলার কুলকিনারা করতে পারছে না দুদক। এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানো সংক্রান্ত রিটে দুদককে পক্ষভুক্ত করায় সংস্থাটি নথির অভাবে মামলার দায় থেকে নিষ্কৃতি চেয়ে অ্যাফিডেভিটও করতে পারছে না।এ প্রসঙ্গে দুদকের প্রধান কৌঁসুলি খুরশিদ আলম খান বলেন, ‘আদালতের সেকশন থেকে এভাবে আরও অসংখ্য মামলার নথি গায়েব করা হয়েছে। দুদকের বেশকিছু মামলার নথিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’ তিনি জানান সাবেক এক মন্ত্রীর দুর্নীতি মামলার ফাইল দীর্ঘদিন ধরেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মন্ত্রীর নাম প্রকাশ না করে দুদক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর অভিযোগ করেছি। তাতেও না পাওয়ায় নথি পুনর্গঠনের জন্য আবেদন করি। এরপর তা পুনর্গঠন করা হয়। এসব করতেও এক বছরের বেশি সময় চলে যায়। এ ছাড়া এক এমপির দুর্নীতি মামলার নথিও গায়েব। মামলার ফাইল হাইকোর্টের শাখায় নেই। খুঁজে বের করতে আমরা লোক লাগিয়েছি। আদালতের কাছেও আবেদন করে ‘মেনশন’ করেছি। কুতুবুর রহমান নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা মামলার নথিও পাওয়া যাচ্ছে না। ফৌজদারি আপিল নং-৩৭৩৩/২০০৮, রিট মামলা নং-৭১৩২/২০০২ ও ৫১৮২০/২০১৮নং মামলার নথি গায়েব করে দেওয়া হয়েছে।’ খুরশিদ আলম খান বলেন, ব্যবসায় প্রতিযোগিতা সংক্রান্ত রিট মামলার নথি কারা গায়েব করছে সেটাও বলতে পারছি না। তবে খোঁজখবর নিচ্ছি। নথির অভাবে শুনানি শেষ করতে পারছি না। মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর বিষয়ে করা রিট মামলায় দুদকের পক্ষ থেকে অ্যাফিডেভিটও করতে পারিনি। কারণ নথি থেকে আমাদের নোট নিতে হয়।’

এ বিষয়ে হাইকোর্টের নথি শাখার (ক্রিমিনাল মিস কেস) সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান  প্রতিদিন এ শাখা থেকে হাজার হাজার ফাইল যায়। আর সেকশনে লোকবল ও জায়গা স্বল্পতাও রয়েছে। এ জন্যই ফাইল হারানোর অভিযোগ উঠে কখনও কখনও। তবে হাইকোর্ট সেকশন থেকে কোনো ফাইল হারায় না।

অভিযোগ পেলে ফাইল উদ্ধার করা হয়।’অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ বিষয়ে বলেন, ‘আদালতের বেঞ্চ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেশির ভাগ এখন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় উচ্চ আদালতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ হবে।’

সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট বাসেত মজুমদার বলেন, ‘হাইকোর্ট থেকে মামলার নথি গায়েবের কথা প্রায়ই শোনা যায়। এটা রোধ করা না গেলে বিচার ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে। সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনকে এ বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে।’
জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক বলেন, ‘অনেক সময় নথি আদালতে পাওয়া যায় না। আবার কিছু অর্থ খরচ করলেই সেটি পাওয়া যায়। এটা চলতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টে মামলা কার্যতালিকায় আনা হতে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুষ দিতে হয়। ফাইল পাওয়া না গেলে তো কথাই নেই। এতে করে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা চরম ভোগান্তির শিকার হন।’