ভারতীয় পেঁয়াজে সয়লাব - বিপাকে কৃষক, আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা

ভারতীয় পেঁয়াজে সয়লাব - বিপাকে কৃষক, আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা
ভারতীয় পেঁয়াজে সয়লাব, বিপাকে ব্যবসায়ীরা

বিশেষ প্রতিবেদক ।।

বড় গুদামগুলোতে এখন অন্যান্য দেশের পেঁয়াজের সাথে ভারতীয় পেঁয়াজেরও সয়লাব হয়েছে। গত তিনদিনে ১৫৬ টন পেঁয়াজ বাজারে এসেছে। যার ফলে বিপাকে পড়েছে কৃষক, আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, চাহিদার তুলনায় দেশের বাজারে অতিরিক্ত পেঁয়াজ আসায় আমরা আগেও একবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এখন আবার ভারত পেঁয়াজ সরবরাহ করছে, এতে আমদানিকারক, ব্যবসায়ী ও কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারত পেঁয়াজ দিতে চাইলেও বাংলাদেশ সরকারের উচিত ছিলো তা গ্রহণ না করা।

জানা যায়, গত সপ্তাহে ভারতের পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা, মিশর ২৭ থেকে ২৮ টাকা, হল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড ২৫ থেকে ৩০ টাকা, তুরষ্ক ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং দেশি ৩২ থেকে ৩৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

গত রবিবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের পেঁয়াজ চাষিদের লোকসানের ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির ওপর শুল্ক বসানো হবে কিনা সেটি চিন্তা করে দেখা হচ্ছে বলে জানালেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

তিনি আরও বলেন, ভারত নিজের স্বার্থে কখনো পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, আবার কখনো তা খুলে দেয়। এখন তারা খুলে দিয়েছে। এমন অবস্থায় ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে ৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে কিনা সে বিষয়টি চিন্তা করে দেখা হচ্ছে। শুল্ক আরোপ নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আলোচনা চলছে বলেও জানান টিপু মুনশি।

বাণিজ্যমন্ত্রী জানান, শুল্ক আরোপ করা হলেও সেটা যাতে ভারত ছাড়া অন্য যেসব দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছিল তাদের উপর প্রভাব না ফেলে সেদিকেও লক্ষ্য রাখা হবে।

দীর্ঘ সাড়ে তিন মাস বন্ধ থাকার পর গত শনিবার থেকে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি শুরু করেছে ভারত। অথচ বন্দরে পড়ে থাকা ২৩ থেকে ২৪ হাজার টন পেঁয়াজ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্র থেকে জানা গেছে, গত ছয় মাসে মিয়ানমার, পাকিস্তান, চীন, মিশর, তুরষ্ক, নেদারল্যান্ড, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আলজেরিয়া, ইরান ও রাশিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশ থেকে ২ লাখ ৯ হাজার ৩৪ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানির জন্য আইপি নিয়েছে ব্যবসায়ীরা। তার বিপরীতে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ বন্দর থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও মজুদে ঘাটতির কারণে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ভারত অন্যান্য দেশে পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে বাংলাদেশের বাজারে লাগামহীন পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে। এমনকি প্রতিকেজি পেঁয়াজ ১৩০ টাকাতেও বিক্রি হয়েছে।

পরে সরকার পেঁয়াজের ওপর আমদানি শুল্ক হ্রাস করার পর ব্যবসায়ীরা অন্যান্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু করে। এ পরিস্থিতির সামাল দিতে সরকার গত বছরের মতো মিয়ানমার, পাকিস্তান, চীন, মিশর, তুরষ্কসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নানা রঙের ও স্বাদের পেঁয়াজ আমদানি করে।

খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের বড় বিপণিকেন্দ্র হামিদুল্লাহ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের পেঁয়াজ আসা শুরু করেছে। সোমবার পর্যন্ত ১২ ট্রাক অর্থাৎ ১৫৬ টন পেঁয়াজ খাতুনগঞ্জের বাজারে এসেছে। এসব পেঁয়াজ প্রতিকেজি ৪৩ থেকে ৪৮ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এতে করে বিভিন্ন পেঁয়াজের দাম গড়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত কমে গেছে।

বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজের প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, বর্তমান বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ আছে। এছাড়া বন্দরেও প্রায় ২৩ থেকে ২৪ হাজার টন পেঁয়াজ পড়ে আছে। এরমধ্যে ভারতীয় পেঁয়াজ বাংলাদেশে কিভাবে আসে- সেটাই হলো বড় প্রশ্ন।

তিনি আরও বলেন, এখন বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘদিন ধরে পেঁয়াজের ব্যবসা করেও বর্তমান বাজারে কারা, কিভাবে পেঁয়াজ আনছে তা আমরা জানতে পারছি না। খোঁজ নিয়ে দেখলে আপনারাই দেখবেন- এসব পেঁয়াজের রপ্তনিকারকই আমদানিকারক।

পেঁয়াজ আমদানিকারক ও চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন বলেন, আমরা সবাই দেশিয় সংকট নিরসনের জন্য কমবেশি পেঁয়াজ আমদানি করেছি। কিন্তু আমদানি করেই এখন লোকসানের মুখে পড়েছি। ভারতের পেঁয়াজ বাজারে আসায় এখন আমাদের আমদানি করা পেঁয়াজগুলো আর বিক্রি হচ্ছে না। দোকানেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কৃষকদের মধ্যে যারা পেঁয়াজ উৎপাদন করেছে তারাই এখন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে পার্থক্য মাত্র ২ লাখ টনের। বছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ২৩ লাখ টনের বেশি। আর চাহিদা রয়েছে ২৪ থেকে ২৫ লাখ টন। তারপরও শুধু নষ্ট হওয়ার কারণে বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ টন পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কারণ দেশে উৎপাদিত ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পেঁয়াজ সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়। পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য যে আধুনিক তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকা দরকার, তা সরকারি বেসরকারি কোনো পর্যায়ে নেই।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলা কর্মকর্তা মো. সেলিম বলেন, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার পর আমরা কৃষকদের পেঁয়াজ উৎপাদনে উৎসাহিত করেছি। বর্তমানে আমাদের দেশিয় উৎপাদন চাহিদার ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ। এখন কৃষকদের ফসলি পেঁয়াজ বাজারে আসছে। বাজারে অন্যান্য দেশের পেঁয়াজও আছে। এর মধ্যে যদি সরকার ভারতীয় পেঁয়াজ বাজারে আসে কৃষকরা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। পরবর্তীতে হয়তো ভারত আবার পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে তখন কৃষকরা আর পেঁয়াজ চাষে আগ্রহী হতে চাইবেন না।

এ বিষয়ে পেঁয়াজ উৎপাদনের সাথে জড়িত কৃষক সাদেক বলেন, দেশিয় পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে ভারত পেঁয়াজ আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। এতে ভারতীয় পেঁয়াজে বাজার ভরে যাচ্ছে। ফলে কৃষক তার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।