বাংলাদেশের ভ্যাকসিন ক্রয় প্রক্রিয়ার নেপথ্য কাহিনী: সালমান এফ রহমান

বাংলাদেশের ভ্যাকসিন ক্রয় প্রক্রিয়ার নেপথ্য কাহিনী: সালমান এফ রহমান
সালমান ফজলুর রহমান। ছবি. সংগৃহীত

পোস্টকার্ড ডেস্ক।।

বাংলাদেশের ভ্যাকসিন ক্রয় প্রক্রিয়ার নেপথ্য কাহিনী বেক্সিমকো গ্রুপ ভাইস চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বাসসকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেন।

বাংলাদেশ সরকার, বেক্সিমকো ফার্মা এবং সেরামের মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রিপাক্ষিক চুক্তির অংশ হিসেবে কেনা হয়েছে মোট ৩ কোটি ডোজ। সোমবার তার প্রথম চালান দেশে এলো।  

অক্সফোর্ড- অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথ উদ্যোগে আবিষ্কৃত কোভিড টিকার ২০ লাখ ডোজ ভারত থেকে উপহার হিসেবে পায় বাংলাদেশ। তার চারদিন পর সোমবার (২৫ জানুয়ারি) কোভিশিল্ড টিকাটির উৎপাদক সংস্থা- সেরাম ইনস্টিটিউড অব ইন্ডিয়ার কাছ থেকে পূর্ব স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায় ৫০ লাখ ডোজের চালান পেয়েছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস।

এনিয়ে বেক্সিমকো গ্রুপ ভাইস চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা- বাসসকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের ভ্যাকসিন ক্রয় প্রক্রিয়ার নেপথ্য কাহিনী তুলে ধরেন।

টিকা ক্রয়ের সফলতার জন্যে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতাকে কৃতিত্ব দেন। তার মতে, একারণেই দেশে বড় আকারে প্রতিষেধকের দ্রুত চালান প্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। সেই তুলনায় প্রতিবেশী দেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে টিকাপ্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি বলেও উল্লেখ করেন তিনি। 

সাক্ষাৎকারের বিশেষ অংশ এখানে তুলে ধরা হলো: 

বাসস: দেশে কোভিশিল্ড টিকার প্রথম চালান এসে পৌঁছেছে। সেকারণে উন্নয়নশীল দেশসমূহ এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে কার্যকর একটি টিকাদান কর্মসূচি শুরু করার দিক দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়েও গেল। এই সফলতা কীভাবে অর্জিত হলো?  

সালমান এফ রহমান: আমি মনে করি, এটি সম্ভব হয়েছে কেবল প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতা ও সাহসের কারণে। সারা বিশ্বে এখন ভ্যাকসিন নিয়ে হাহাকার। 

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে (ইইউ) অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও ফাইজার জানিয়েছে তারা প্রত্যাশা অনুযায়ী টিকা সরবরাহ করতে পারবে না। কোরিয়া, জাপান, থাইল্যান্ডের মতো দেশ কিংবা পাকিস্তানে কিছু শুরুই হয়নি। অথচ আমরা ত্বরিত গতিতে টিকাদান কর্মসূচি শুরু করছি। কেবলমাত্র প্রতীকীভাবে নয়, একেবারে পরিকল্পনামাফিক।

প্রশ্ন: বেক্সিমকো কীভাবে এই টিকা ক্রয় ও আমদানির সাথে যুক্ত হলো?

উত্তর: সেরাম ইন্সটিটিউট বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন উৎপাদক। বেক্সিমকো থেকে আমরা যোগাযোগ করে বললাম যে, আমরা বাংলাদেশে তোমাদের পরিবেশক হতে চাই। তারা প্রথমে অনাগ্রহী ছিল, তবে পরে জানালো, আমাদেরকে তখনই কিছু বিনিয়োগ করতে হবে। কারণ, তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে হবে। তখন অগ্রিম টাকা বিনিয়োগ করে আমরা পরিবেশক হলাম।

এরপর আমরা সেরামকে বললাম, কবে নাগাদ টিকা পাওয়া সম্ভব? তারা বললো, প্রথম ধাপের টিকা শুধুমাত্র গ্যাভি ও কোভ্যাক্সকে দিতে হবে, আর দিতে হবে ভারত সরকারকে। আর ভারত যেহেতু বড় দেশ, ফলে চাহিদাও অনেক বেশি। তাই, প্রথমেই টিকা দেওয়া যাবে না। আমরা তখন বললাম, ভারতের সাথে আমাদের এত সুসম্পর্ক। আমাদের দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ভীষণ ভালো সম্পর্ক। আমাদের আগে টিকা দিতে সমস্যা কোথায়! তখন তারা বললো, ভালো সম্পর্কের খাতিরে ভারত সরকার তোমাদের সরকারকে কিছু টিকা হয়তো দেবে। সেটা দুই সরকারের ব্যাপার। কিন্তু, বেসরকারি কোম্পানি হিসেবে এখানে আমাদের করণীয় কী?

তারপরও ,আমরা জোরাজুরি করে বললাম, আমাদেরকে কিছু টিকা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দিতেই হবে। আমরা তখন অনুমোদন পাওয়ার পর প্রথম ধাপে ৫ কোটি টিকার জন্য জোরাজুরি করছিলাম। তখন সেরামের কাছে মাত্র ১০ কোটি ডোজ ছিল।

আমাদের মাথায় ছিল যে, সাথে সাথে টিকা না পেলে, পরে অনেক কয়েক মাস দেরি হয়ে যাবে। গ্যাভি বা কোভ্যাক্স থেকে পেতেও ২ থেকে ৩ মাস দেরি হবে এবং তারা দেবেও অল্পসংখ্যক। আমাদের জোরাজুরির পর সেরাম বললো, একটা উপায় আছে। তোমাদের সরকারের সাথে আমরা চুক্তি করবো যে মাসে ৫০ লাখ করে ৬ মাসে ৩ কোটি ডোজ দেব। কিন্তু টাকাটা এখনই অগ্রিম পরিশোধ করতে হবে।

আমরা তখন বললাম, তোমাদের ভ্যাকসিন অনুমোদনই পায়নি, আর এখনই টাকা দিতে হবে? তারা বললো, প্রথম ধাপে নিতে হলে এখনই অগ্রিম দিতে হবে। অন্যথায় সম্ভব নয়। অগত্যা আমরা রাজি হলাম।

আমি এরপর প্রধানমন্ত্রীকে জানালাম যে, ৩ কোটি ডোজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেওয়ার ব্যাপারে আমরা সেরামকে রাজি করিয়েছি। তবে তারা শর্ত দিয়েছে অগ্রিম অর্থ দিতে হবে। তিনি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলেন। একেই আমি প্রধানমন্ত্রীর দুরদর্শিতা ও সাহস বলছিলাম।

প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমরা এখন ৫০ শতাংশ অগ্রিম দেব। বাকি অর্ধেক দেব টিকা অনুমোদন পেলে। সেরাম এই শর্তে সম্মত হলো। এছাড়া, প্রধানমন্ত্রী বললেন ভারতের দামে টিকা পাওয়া সম্ভব কিনা। তখন সেরাম ভারত সরকারকে ৫ মার্কিন ডলারে বিক্রির প্রস্তাব করেছে, ভারত ৩ ডলারে দর কষাকষি করছে। 

আমি আমাদের ফার্মার এমডি নাজমুল হাসান পাপনকে বললাম, সেরামের সাথে এই বিষয়ে আলাপ করতে। তারই ফলশ্রুতিতে উভয় পক্ষ সম্মত হয় যে, আপাতত দাম হবে ডোজপ্রতি ৪ ডলার। কিন্তু সেরাম যদি ভারত সরকারকে আরও কম দামে দেয়, আমাদেরকেও একই দামে দিতে হবে।

এরপর আমরা প্রথমেই ৬ কোটি ডলার বা অর্ধেক অগ্রিম পরিশোধ করলাম। আর একারণেই পৃথিবীর অনেক দেশ যখন টিকাই পাচ্ছে না, আমরা তখন এত সুবিধাজনক অবস্থানে আছি।

প্রশ্ন: সম্প্রতি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে এসেছে যে, ভারতের চেয়ে প্রায় ৪৭ শতাংশ বেশি দাম দিতে হবে বাংলাদেশকে। কিন্তু আপনারা বারবার বলে এসেছেন যে, বাংলাদেশ ও ভারত সমান মূল্য পরিশোধ করবে। আপনারা কি একই অবস্থানে অনড় আছেন?

উত্তর: অবশ্যই! রয়টার্সের ওই প্রতিবেদনে আমাদের কোনো বক্তব্য নেওয়া হয়নি। নিলে এতটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতো না। যাইহোক, কথা হলো, ভারত ও বাংলাদেশ যে সমান মূল্যে ভ্যাকসিন কিনবে, এটি চুক্তিতেই আছে। সেরাম একটি মাল্টি-বিলিয়ন ডলার কোম্পানি। তারা বাংলাদেশ সরকারের সাথে চুক্তি করেছে। একটি সরকারের সঙ্গে করা চুক্তি ভঙ্গ করে তারা কী নিজেদের সুনাম নষ্ট করবে?

চুক্তিতে উল্লেখ আছে, ভারত যদি ৪ ডলারের বেশিতে সম্মত হয়, আমরা কিন্তু ৪ ডলারের বেশি পরিশোধ করবো না। কিন্তু, ভারত ৪ ডলারের চেয়ে কম দামে কিনলে, আমাদেরও সেই দামে দিতে হবে! এর চেয়ে ভালো চুক্তি আর কী হতে পারে? এখন ভারত ২০০ রুপি বা ২ দশমিক ৮ ডলারে ভ্যাকসিন কিনবে। এটাতো খুশির খবর! আমরা ৪ ডলারের পরিবর্তে ২ দশমিক ৮ ডলার পরিশোধ করবো।

এখন আমাদের সামনে টাকা ফেরত চাওয়া বা পরবর্তীতে সমন্বয় করে নেওয়ার সুযোগ আছে। তবে, প্রধানমন্ত্রী টাকা ফেরত বা মূল্য সমন্বয়ের পরিবর্তে উদ্বৃত্ত অর্থে আমাদেরকে আরও ভ্যাকসিন নিতে বলেছেন। অর্থাৎ আমরা একই টাকায় ৩ কোটির পরিবর্তে ৪ কোটি বা তারও বেশি টিকা পেতে পারি।

প্রশ্ন: সেরাম ইন্সটিটিউটের সিইও আদর পুনাওয়ালার সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকার নিয়ে ভারত থেকে টিকা রপ্তানি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়। সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীরা বিষয়টি লুফে নেয়। তবে, বেক্সিমকো ও সরকার সময়মতো টিকা আসার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসীই ছিল। অবশেষে আপনাদের অবস্থানই সঠিক প্রমাণিত হচ্ছে, এমনটা বলবেন কী?

উত্তর: তা তো বটেই! আমরা বলেছিলাম যে, ২৫ তারিখের মধ্যে টিকা আসবে। ২৫ তারিখেই আসলো। আমাদের সুশীল সমাজ, বিরোধীদল সবাই তো বলে দিয়েছিল যে, না, টিকা আসবে না। এই সময় আমাদের কতভাবে হেয় করার চেষ্টা করা হয়েছে! কিন্তু আমরা চুপ ছিলাম। শুধু বলেছি সময়মতো টিকা আসবে। টিকা সময় মতোই এসেছে।

প্রশ্ন: একটি প্রশ্ন অনেকের মধ্যে আছে যে, কেন শুধু অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ? ফাইজার, মডের্না বা চীন, রাশিয়ার টিকা নয় কেন?

উত্তর: সরকার কোনোদিন বলেনি যে, শুধু একটি টিকা আনা হবে। সরকার কিছুদিন আগে বলেছে যে, ফাইজারের টিকা নেওয়া হবে। কিন্তু ফাইজার বা মর্ডানার টিকার সমস্যা কোল্ড স্টোরেজ নিয়ে। সারাদেশে এই টিকা বিতরণের অবকাঠামো আমাদের নেই। ঢাকা শহরে ১ থেকে ২টা ওই মানের কোল্ড স্টোরেজ আছে। ফলে, ঢাকায় হয়তো সীমিত আকারে এই টিকা বিতরণ করা যাবে।

আমাদের টিকা লাগবে অনেক বেশি! আর সেরাম থেকে আমরা যে পরিমাণে আনছি, এই পরিমাণ অন্য কোনো কোম্পানি দিতে পারছে না। নিজের দেশকেই তারা দিতে পারছে না! পাকিস্তান চীনের খুব ভালো বন্ধু, কিন্তু চীন নিজস্ব ভ্যাকসিনের মাত্র ৫ লাখ ডোজ পাকিস্তানকে উপহার দিয়েছে। বাকিটা কিনতে হবে, কিন্তু কখন সরবরাহ হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। 

ব্রাজিল, ভারতে বিমান পাঠাতে চেয়েও লাভ হয়নি। ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ড সেরামের এই টিকা ৭ ডলারের উপরে কিনছে, তারপরও এখন পাবে না; পাবে জুনে! ভারতের পর বাংলাদেশ ছাড়া কেউই ৫ ডলারের নিচে এ টিকা পায়নি, আর অগ্রাধিকারে তো নয়ই। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, জানুয়ারির ২৫ তারিখের মধ্যে বিশ্বের কোনো কোম্পানি আমাদের ৫০ লাখ টিকা দিতে পারতো না।

দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশে ওষুধ অনুমোদনের বিশেষ নিয়ম আছে। কোনো ওষুধ উৎপাদন বা আমদানি করতে হলে, যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ, যুক্তরাজ্যের এমএইচআরএ, ইইউ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এদের যে কোনো একটির অনুমোদন থাকতে হবে। ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও সেই কথা প্রযোজ্য। অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন যুক্তরাজ্যে অনুমোদন দিয়েছে, এরপর ভারত ও তারপর আমরা দিয়েছি। কিন্তু, শুধু যদি ভারত অনুমোদন দিতো, তাহলে আমরা আনতে পারতাম না। বিনামূল্যে দিলেও পারতাম না। যুক্তরাজ্যের অনুমোদন থাকায় পারছি। চীন বা রাশিয়ার ভ্যাকসিন এই সংস্থাগুলোর কোনোটির অনুমোদন পায়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেলে হয়তো সেগুলো আনা যাবে।

আর দামের ইস্যুতো আছেই। ফাইজার ও মডার্না তো বটেই, চীন ও রাশিয়ার ভ্যাকসিনের দামও সেরামের ভ্যাকসিনের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।

(সংক্ষেপিত)