বাংলাদেশে চালু হয়েছে মাতৃদুগ্ধ ব্যাংক, শীর্ষ আলেমরা কী বলছেন ?

বাংলাদেশে চালু হয়েছে মাতৃদুগ্ধ ব্যাংক, শীর্ষ আলেমরা কী বলছেন  ?

মুফতি আমিন ইকবাল ।।

"হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক" বা মায়ের বুকের দুধ সংরক্ষণ ব্যবস্থা বাংলাদেশে চালু হয়েছে। প্রথমবারের মতো উদ্যোগটি নিয়েছে ঢাকা মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের নবজাতক পরিচর্যা কেন্দ্র (স্ক্যানো) ও নবজাতক আইসিইউ (এনআইসিইউ) বিভাগ। ১ ডিসেম্বর থেকে চালু হলেও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে বেসরকারি আর্থিক সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাংক।

জানা যায়, যে মায়েদের সন্তান জন্মের পর মারা গেছে বা নিজের সন্তানকে খাওয়ানোর পরও মায়ের বুকে অতিরিক্ত দুধ আছে, সেই মায়েরা হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকে দুধ সংরক্ষণ করে রাখতে পারবেন। আর যে নবজাতকের জন্মের পরই মা মারা গেছেন বা যাদের মা অসুস্থতার জন্য দুধ খাওয়াতে পারছেন না, সেই নবজাতকেরা সংরক্ষিত এই দুধ খেতে পারবে। তা ছাড়া দত্তক নেওয়া সন্তানের অভিভাবকেরা এখান থেকে দুধ নিয়ে খাওয়াতে পারবেন। বিভিন্ন সময় স্বজনেরা নবজাতককে ফেলে দেন, এই স্বজন-পরিত্যক্ত নবজাতকদের বাঁচাতেও মিল্ক ব্যাংক কার্যকর ভূমিকা পালন করবে বলে জানিয়েছে উদ্যোক্তারা। আরও জানা যায়, মায়ের বুকের দুধ সংগ্রহ ও বিতরণে কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেন করা হবে না।

তবে মায়ের দুধের এমন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা নিয়ে আপত্তি উঠেছে দেশের শীর্ষ আলেম ও মুফতিদের থেকে। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন এমন উদ্যোগ নবজাতক অনেক শিশুর জন্য আপাতদৃষ্টিতে উপকারী মনে হলেও মুসলিম সমাজের আত্মীয়তার বন্ধনে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করবে। কারণ হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক থেকে দুগ্ধ পানকারী শিশুরা কোন মায়ের দুধ পান করছে, তা অজানা থাকার সম্ভাবনা থেকে যাবে। যেহেতু মিল্ক ব্যাংকে একসঙ্গে অনেক মায়ের দুধ একত্রিত থাকবে, তাই কার দুধ তাকে দেওয়া হচ্ছে, তা নির্ণয় করাও অসম্ভব হয়ে যাবে। ফলে তার অজানা অসংখ্য দুধ ভাই-বোনের সৃষ্টি হবে; ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক যাদের সঙ্গে তার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া কঠোরভাবে হারাম। ফলে তার বিবাহের সময় এই আশঙ্কা পূর্ণমাত্রায় থেকে যাবে যে, যাকে সে বিয়ে করছে, সে তার দুধ ভাই-বোন কি না!

বিষয়টি নজরে এসেছে সুপ্রিমকোর্টেরও। ইতোমধ্যে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক নিয়ে আইনি নোটিস প্রেরণ করেছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মাহমুদুল হাসান। ধর্ম মন্ত্রণালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইসিএমএইচ), নবজাতক পরিচর্যা কেন্দ্র (স্কানো), নবজাতক আইসিইউ (এনআইসিইউ) এবং ঢাকা জেলা প্রশাসককে ডাকযোগে পাঠানো নোটিসে বলা হয়, ‘মিল্ক ব্যাংক’ ইস্যুতে ধর্মীয় সমস্যা রয়েছে। তা ছাড়া দেশে মিল্ক ব্যাংক করা ১৯৩৭ সালের মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। তাই নোটিস অনুসারে মিল্ক ব্যাংক স্থাপনে যথাযথ শর্ত আরোপ চাওয়া হয়েছে। অন্যথায় এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও নোটিসে উল্লেখ করা হয়।

অন্য মায়ের দুধ পানে ইসলাম কী বলে
শিশুর জন্মদাতা মা ছাড়া অন্য মহিলারাও দুধ পান করাতে পারবেন। ইসলাম একে সমর্থন করে। নবী (সা.) স্বয়ং অন্য মায়ের দুধ পান করেছেন। তার দুধ মা ছিলেন হালিমা সাদিয়া। তবে এ ক্ষেত্রে ইসলামে বড় বিধান হলো শিশু দুই বছর বয়সের মধ্যে যে মায়ের দুধ পান করবে সে তার দুধ মা হিসেবে গণ্য হবে। আর দুধ মা নিজের মায়ের মতোই। ফলে ওই মহিলার সন্তানরা তার দুধ ভাই-বোন হয়ে যায়। চাই মহিলার স্তন থেকে সরাসরি পান করুক, চাই দুধ বের করে অন্য মাধ্যমে পান করুক। (ফাতাওয়ায়ে ফকিহুল মিল্লাত : ৬/২৩২)

শীর্ষ আলেম ও মুফতিদের বক্তব্য
ইসলামের দৃষ্টিতে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’-এর বৈধতা আছে কি না জানতে চাইলে ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা মাদ্রাসার মহাপরিচালক মুফতি আরশাদ রাহমানী বলেন, যেহেতু এটা দুধ পানের বিষয়, এ নিয়ে ইসলামে নির্দিষ্ট মাসয়ালা রয়েছে। মৌলিকভাবে এক মায়ের দুধ অন্য মায়ের শিশু খাওয়া জায়েজ। মায়ের দুধ যেকোনো প্রক্রিয়ায় বের করে অন্য শিশুকে খাওয়ানো জায়েজ। তবে ইসলামে রক্তের সম্পর্ক এবং দুধ ভাই-বোনের সম্পর্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আপন ভাই-বোনের মধ্যে যেমন বিয়ে করা যায় না তেমনি দুধ ভাই-বোনের মধ্যেও বিয়ে করা ইসলামে নিষিদ্ধ।’

তিনি বলেন, ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের দুধ প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাবে। এ ক্ষেত্রে কোন মায়ের দুধ কোন শিশু খাচ্ছে এটা জানা যাবে কি না তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। যদি জানা না যায় তাহলে একদিকে যেমন ইসলামে দুধ মায়ের যে গুরুত্ব সেটা ক্ষুণ্ন হবে। অন্যদিকে এমন হতে পারে পরবর্তী সময়ে দুধ ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অবশ্য কোন মায়ের দুধ কোন শিশু খাচ্ছে এটা যদি জানা যায় এবং দুই পরিবারের মধ্যে এ বিষয়ে সতর্ক থাকেন তাহলে সমস্যা নেই। তবে বাস্তবে সবাই কতটা সতর্ক থাকবে সেটা দেখার বিষয়। তাছাড়া উদ্যোক্তারা কতটুকু শরিয়তের বিধান মানবে, সেটাও ভাববার বিষয়। তাই আমি মনে করি এ ধরনের ব্যাংক না হওয়াই নিরাপদ।’

রাজধানীর শায়েখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মহাপরিচালক মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের উদ্যোগ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এই প্রক্রিয়া ব্যাপকতা লাভ করলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। অসংখ্য হারাম বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে সবার অজান্তেই। যা সামাজিক বিপর্যয় ডেকে আনার পাশাপাশি ইসলামী পরিবারপ্রথাকেও হুমকির মুখে ফেলবে। তাই এই বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে।’

মুসলিমদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করা সংগঠন ওআইসির ইসলামী বিধান বিষয়ক বিশেষ বোর্ড ‘মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী’ (international Islamic Jurist Of OIC)) হিউম্যান মিল্ক ব্যাংককে হারাম ঘোষণা করেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন ‘১০-১২ বছর আগে বিশ্বের মুহাক্কিক সব আলেমই হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক ব্যবহার ও প্রতিষ্ঠাকে নাজায়েজ ঘোষণা করেছেন।

সৌদি আরবের জেদ্দায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক একটি ফিকহি সেমিনারে নানা পর্যালোচনার পর এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেমিনারে আল্লামা তকি উসমানি ও আল্লামা ইউসুফ আল-কারজাভিসহ বিশ্বের খ্যাতিমান ফিকহ-বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন।’

চট্টগ্রাম ওমর গণী এমইএস বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও অধ্যক্ষ ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন শর্ত সাপেক্ষে এমন উদ্যোগ চলতে পারে উল্লেখ করে বলেন, ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক করা মানবিকতার দৃষ্টিতে খুবই প্রসংশনীয় উদ্যোগ। এতে শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি কমবে।

কিন্তু এতে করে পরিবার প্রথা ভেঙে যাওয়ার একটা আশঙ্কা তৈরি হয়। ইসলামে দুধ মায়ের যে বিধান তথা দুধ ভাই-বোনকে বিয়ে শাদি করা যে হারাম এই বিধান অনেকটাই লঙ্ঘন হবে। কারণ, কে কার দুধ খেল তা তো জানা যাবে না। তবে যদি কর্তৃপক্ষ প্রত্যেকের দুধ আলাদা করে রাখে এবং প্রত্যেক মায়ের বিস্তারিত (তার সন্তানসহ) পরিচয় লিখে রাখে, তেমনি যে শিশু এখান থেকে দুধ খাবে তার বিস্তারিত লিখে রাখে এবং পরস্পরকে এসব তথ্য গুরুত্বের সঙ্গে আদান-প্রদান করে তাহলে জায়েজের একটা সুযোগ থাকবে। তবে এ প্রক্রিয়া অনেক কঠিন এবং এ জন্য বিশেষজ্ঞ আলেম-মুফতিদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, এই বিষয়টা যেহেতু বাংলাদেশে নতুন এবং আয়োজকরা কতটুকু শরিয়ত সম্মত করতে পারবে এসব বিষয় নিয়ে আরও আলোচনা-পর্যালোচনা হওয়া দরকার। দেশের শীর্ষ আলেম ও মুফতিদের নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে গোলটেবিল হলে আরও নতুন নতুন পথ উন্মুক্ত হবে।

মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট মিল্ক ব্যাংক না করে মধ্যস্থতার দায়িত্ব পালন করতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষ এমন মায়েদের তালিকা নিজেদের কাছে সংরক্ষণ রাখতে পারে যাদের অন্য বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর মতো সুযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে কোনো শিশুর দুধ প্রয়োজন হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই মায়ের সঙ্গে সংযোগ করে দিয়ে দুধ পানের ব্যবস্থা করে দিতে পারে। এতে করে দুধ মা কে তা নির্দিষ্ট থাকল।

শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বক্তব্য
মাতুয়াইলে প্রতিষ্ঠিত হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের সমন্বয়ক ডা. মুজিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ধর্মীয় সব বিষয় মাথায় রেখে এবং ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করেই এটা করা হয়েছে বিপন্ন শিশুদের কথা চিন্তা করে। মুসলিমদের জন্য কোনটা করা যাবে আর কোনটা করা যাবে না এ নিয়ে কয়েক মাস আমরা কাজ করেছি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আলেমদের সামনে ব্রিফিং করেছি। আমরা নিশ্চিত করেছি যে এটি নিয়ে বিভ্রান্তির সুযোগ নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি মায়ের দুধ আলাদা বিশেষ পাত্রে নেওয়া হবে এবং আলাদা লেবেলিং থাকবে যা কখনও নষ্ট হবে না। যিনি দুধ দেবেন তার অনুমতি নেওয়া হবে। তিনি নিজেও নিজের দুধ প্রয়োজনে নিতে পারবেন বা অন্য কেউ নিলে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে আইডি কার্ড থাকবে। দাতা ও গ্রহীতা এ বিষয়ে একে অন্যের বিস্তারিত জানতে পারবে।’

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বক্তব্য
তবে ইসলামিফ ফাউন্ডেশন (ইফা) এ ব্যাপারে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। ইফার প্রধান মুফতি মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেছেন, মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট আমাদের সঙ্গে কথা বলেছে। কিন্তু বিষয়টি যেহেতু বাংলাদেশে নতুন এবং জটিল বিষয় তাই আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা অন্যান্য মুফতিদের সঙ্গেও এ নিয়ে আলোচনা করব। বিশেষ করে মুফতি আব্দুল মালেক সাহেবসহ কয়েকজন শীর্ষ মুফতিকে নিয়ে আমরা অচিরেই বসব। এর আগে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের’ বৈধতা-অবৈধতা বিষয়ে কিছুই বলা যাচ্ছে না।

লেখক : আলেম ও সাংবাদিক