প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসছে কড়া নিরাপত্তাবলয়

পোস্টকার্ড প্রতিনিধি ।।

প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসছে কড়া নিরাপত্তাবলয়
প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসছে কড়া নিরাপত্তাবলয়

সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় তাদের ক্যাম্পগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে । কক্সবাজার জেলা পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে।

রোহিঙ্গাদের জন্য বিশেষায়িত পুলিশ ইউনিট গঠন ছাড়াও তিনটি থানা ও একাধিক পুলিশ তদন্তকেন্দ্র স্থাপনের চিন্তাভাবনা চলছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় তাদের মামলা নিষ্পত্তির জন্য ক্যাম্প এলাকায় অস্থায়ী আদালত স্থাপনের প্রস্তাবনাও রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে এসব তথ্য মিলেছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনকারী গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, প্রত্যাবাসনের পক্ষে ও বিপক্ষে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন গোষ্ঠী অবস্থান নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের ‘হিট পয়েন্ট গ্রুপ’ ও ‘আল-ইয়াকিন’সহ কয়েকটি গোষ্ঠী হত্যা, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় ও মাদক চোরাচালানের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।

এটি দিন দিন বেড়েই চলেছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে তিনটি দল তৈরি হওয়ায় অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। একটি গোষ্ঠী কোনোভাবেই মিয়ানমার ফিরে যেতে আগ্রহী নয়। দ্বিতীয় দলটি অন্য কোনো দেশে অভিবাসী হতে চাচ্ছে এবং অপর গোষ্ঠীটি পূর্ণ নাগরিক মর্যাদা পেলে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাচ্ছে।

এ নিয়ে গোষ্ঠীগুলোর মতবিরোধের কারণে নতুন অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে।

ক্যাম্প এলাকায় ‘মাঝি’দের (রোহিঙ্গা নেতা) সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকা নিয়েও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এর বাইরে রোহিঙ্গাদের অসহিষুষ্ণ আচরণ ও উগ্র মনোভাবের কারণে ক্যাম্প এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রতিনিয়তই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

কক্সবাজার জেলার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসাইন বলেন, তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এরপরও বাস্তব কিছু সমস্যা মোকাবেলায় পুলিশ সদর দপ্তরে বেশকিছু প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন না হওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ক্যাম্পগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

তিনি বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গত বুধবারও তারা চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজির নেতৃত্বে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় চলমান কৌশল হালনাগাদ ও বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, ক্যাম্পগুলোতে নতুন নতুন অপরাধ যুক্ত হচ্ছে। শুস্ক মৌসুম হওয়ায় রোহিঙ্গাদের একটি অংশ পাহাড়ি পথ ধরে হেঁটে ক্যাম্প ছেড়ে বিভিন্ন স্থানে অবাধে যাতায়াত করছে। এ অবস্থায় ক্যাম্পগুলোতে জরুরিভিত্তিতে সীমানা প্রাচীর বা কাঁটাতারের বেষ্টনী গড়ে তোলার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সিসিটিভি স্থাপন করাও জরুরি। বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তরকে অবহিত করা হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে ক্যাম্পগুলোতে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধে ৭৬টি মামলায় ১৫৯ জন অভিযুক্ত ছিল। গত দেড় বছরে অপরাধ সংঘটনের প্রবণতা ও অপরাধীর সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৮ সালের শুরু থেকে গত আগস্ট পর্যন্ত ৫১৫ রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে ১৮৭টি মামলা হয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্বল্পসংখ্যক সদস্য নিয়ে এসব মোকাবেলা করা সম্ভব হচ্ছে না।

পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গাদের অপরাধ কার্যক্রম ঠেকাতে এবং নিরাপত্তার জন্য মাঠপর্যায় থেকে ক্যাম্প এলাকায় অন্তত তিনটি থানা এবং একাধিক পুলিশ তদন্তকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ক্যাম্প এলাকায় একটি অস্থায়ী আদালত স্থাপন করারও প্রস্তাবনা এসেছে। এসব বিষয় যাচাই করা হচ্ছে।

ক্যাম্পগুলোতে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে চলেছে। সে তুলনায় পর্যাপ্ত পুলিশ নেই। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার নিরাপত্তা ও ক্যাম্পের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় এক হাজার ৫৫০ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে শুধু রোহিঙ্গাদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় ১৪ এপিবিএনের ৫৮৮ জন সদস্য রয়েছেন। এর বাইরে ৯ এপিবিএনের (আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন) ৩০৭, ৪ এপিবিএনের ৪৩, চট্টগ্রাম রেঞ্জের বিভিন্ন জেলার ৩৫৭ এবং বাকি ২২৫ জন পুলিশ সদস্য কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ির।

এর মধ্যে গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে ১৪ এপিবিএন যাত্রা শুরু করলেও এখন পর্যন্ত পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। গত বছরের মার্চে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও ক্যাম্পের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পৃথক দুটি ইউনিট গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হলেও শুধু ১৪ এপিবিএন গঠিত হয়। এখনও অন্য ইউনিট গঠিত হয়নি।

পুলিশ সূত্র বলছে, কক্সবাজার জেলা পুলিশ ক্যাম্প এলাকা পরিদর্শনে থাকা আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি, এনজিও কর্মকর্তা ও সরকারের ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধিদের নিরাপত্তা প্রটোকল দিতে ব্যস্ত থাকে। বিভিন্ন জেলা থেকে ৩৬৭ জন অফিসার ও ফোর্স ১৫ দিন বা এক মাসের জন্য দায়িত্ব পালন করতে আসায় কাজের প্রতি তাদের তেমন আগ্রহ থাকে না। তারা শুধু নির্দিষ্ট সময় পার করার অপেক্ষায় থাকেন। তা ছাড়া ক্যাম্পগুলোতে দায়িত্ব পালন করা পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের থাকা-খাওয়া বা যাতায়াতের ব্যবস্থাও নেই। তাদের জন্য নেই কোনো বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা।

পুলিশ সদর দপ্তরের অর্গানাইজেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের আলাদা ইউনিট গঠন কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এরই মধ্যে নতুন একটি এপিবিএন ইউনিট দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেছে। অপর একটি নতুন ব্যাটালিয়ন গঠনের প্রস্তাবও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও ক্যাম্পের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় গত বছরের মার্চে পুলিশের আলাদা দুটি ইউনিট গঠনের প্রস্তাবনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হলে এ ইউনিটের দায়িত্ব কী হবে, তাদের কোথায় নিয়োজিত করা হবে, সেই বিবেচনায় তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়ায় নতুন আরেকটি ইউনিট গঠনের কার্যক্রম জোরেশোরেই শুরু হয়েছে।