পবিত্র শবে বরাতে রাসুল ( দ.) যে আমল করতেন, মুসলিম মনীষীদের চোখে শবে বরাত

পবিত্র শবে বরাতে রাসুল ( দ.) যে আমল করতেন, মুসলিম মনীষীদের চোখে শবে বরাত

ইসলাম ডেস্ক ।। 

শাবান মাসের ১৪ তারিখ রাত মুসলমানদের অন্যতম একটি রাত। ভারতীয় উপমহাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে এ রাত ‘শবে বরাত’ নামে পরিচিত। মহানবী (সা.) দিবসটি ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে কাটাতেন। তিনি পুরো রাত জেগে ইবাদত করতেন। রাতভর নফল নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত, তসবিহ-তাহলিল পাঠ, তওবা-ইস্তেগফার ইত্যাদি আমলে মশগুল থাকতেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, ‘পাঁচটি রাত এমন আছে, যে রাতে বান্দার কোনো দোয়া ফেরত দেওয়া হয় না। আর তা হলো-জুমার রাতের দোয়া, রজব মাসের প্রথম রাতের দোয়া, নিসফা শাবান তথা অর্ধ শাবানের রাতের দোয়া, ঈদুল ফিতর তথা রোজার ঈদের রাতের দোয়া, ঈদুল আজহা তথা কুরবানির ঈদের রাতের দোয়া।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক : ৭৯২৭)

আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) রাতে নামাজে দাঁড়িয়ে এত দীর্ঘ সময় সেজদায় রইলেন যে, আমার ধারণা হলো, হয়তো তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তখন আমি তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিয়ে দেখলাম। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘হে আয়েশা, ওহে হুমাইরা! তোমার কি আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন?’ আমি উত্তরে বললাম, ‘না, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার দীর্ঘ সেজদায় আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না।’ রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি জানো এটা কোন রাত?’ আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) ভালো জানেন। তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত অর্থাৎ শাবানের ১৪ তারিখের দিনগত রাত। আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে তাঁর বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন, বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই’ (শুয়াবুল ঈমান : ৩৫৫৪)। শবে বরাতে নবীজি (সা.) রাতভর ইবাদত করতেন এবং দিনের বেলা রোজা রাখতেন। উম্মে সালমা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে শাবান ও রমজান ছাড়া দুই মাস একাধারে রোজা রাখতে দেখিনি। (আবু দাউদ : ২৩৩৬)

শবে বরাতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফার করা। কারণ বরকতময় এই রাতে আল্লাহ তায়ালা প্রথম আকাশে এসে বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন। তাদের গুনাহগুলো মাফ করেন। হাদিস শরিফে বিবৃত হয়েছে, রাসুল (সা.) বললেন, ‘যখন অর্ধ শাবানের রাত আসে তখন আল্লাহ তায়ালা প্রথম আকাশে অবস্থান করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষপোষণকারী ছাড়া অন্যদের ক্ষমা করে দেন’ (মুসনাদে বাজজার : ৮০)। তবে এ রাত কেন্দ্র করে ভিত্তিহীন কোনো কাজ করা যাবে না। হাদিস শরিফে শবে বরাতে রাসুল (সা.) থেকে বিশেষ পদ্ধতির কোনো ইবাদত প্রমাণিত নেই এবং সাহাবায়ে কেরামদের থেকেও এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। সুতরাং আমাদের সমাজে প্রচলিত শবে বরাতের বিশেষ পদ্ধতির যে নামাজের কথা বলা হয় তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বানোয়াট। এগুলো বিশ্বাস করা এবং এগুলোর ওপর আমল করা জায়েজ নেই। আসুন, আমরা অর্থনৈতিক সংকটময় পরিস্থিতিতে এই রাতে আল্লাহর দিকে মনোযোগী হই, বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং বিশুদ্ধ আমলের মাধ্যমে শবে বরাতের ফজিলত, বরকত ও মাগফিরাত হাসিল করি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তওফিক দান করুন।

 

মুসলিম মনীষীদের চোখে শবে বরাত

ইসলাম ধর্মের যেসব ইবাদত সামাজিক পরিমণ্ডলে বিশেষ আন্দোলন ও আবেগ সৃষ্টি করেছে তার মধ্যে অন্যতম শবে বরাত। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সব স্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে শান্তিময় ও ইবাদতমুখর আবহ। তাই দেড় হাজার বছরের বরেণ্য মুসলিম মনীষীরা শবে বরাত সম্পর্কে কী বলেছেন, তা একনজরে দেখে নেওয়া যাক।

ফিকহে হানাফির চোখে : আল্লামা শামি, ইবনে নুজাইম, আল্লামা শরমবুলালি, শায়খ আবদুল হক দেহলবি, মাওলানা আশরাফ আলী থানবি, মাওলানা আবদুল হক লখনবি, মুফতি মুহাম্মদ শফিসহ উলামায়ে হানাফিয়ার অভিমত হলো, শবে বরাতে শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী রাত জেগে একাকীভাবে ইবাদত করা মুস্তাহাব। তবে এর জন্য জামাতবদ্ধ হওয়া যাবে না। (আদ-দুররুল মুখতার : ২/২৪-২৫; আল বাহরুর রায়েক : ২/৫২)

ফিকহে শাফেয়ির চোখে : ইমাম শাফেয়ি (রহ.)-এর মতে, শাবানের ১৫তম রাতে অধিক পরিমাণ দোয়া কবুল হয়ে থাকে। (কিতাবুল উম্ম : ১/২৩১)

ফিকহে হাম্বলির চোখে : ইমাম ইবনে হাম্বলি (রহ.), আল্লামা মনসুর আল বাহুতি, ইবনে রজর হাম্বলি প্রমুখ হাম্বলি উলামায়ে কেরামের মতে শবে বরাতে ইবাদত করা মুস্তাহাব। (আল মাবদা : ২/২৭; কাশফুল কিনা : ১/৪৪৫)

ফিকহে মালেকির চোখে : ইবনে হাজ মালেকি (রহ.) বলেন, সালফে সালেহিনরা এ রাতকে যথেষ্ট সম্মান করতেন এবং এর জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। (আল মাদখাল : ১/২৯২)

ইমাম ইবনে তাইমিয়ার চোখে : আবদুল আব্বাস আহমাদ ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ১৫ শাবানের রাতের ফজিলত সম্পর্কে একাধিক মারফু হাদিস এবং আসারে সাহাবা বর্ণিত রয়েছে। এগুলো দ্বারা এ রাতের ফজিলত ও মর্যাদা প্রমাণিত হয়। সালফে সালেহিনের কেউ কেউ এ রাতে নফল নামাজের ব্যাপারে যত্নবান হতেন। আর শাবানের রোজার ব্যাপারে তো সহি হাদিসগুলো রয়েছে। (ইকতিযাউস সিরাতুল মুস্তাকিম : ২/৬৩১)

শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানির চোখে : আহলে হাদিস ইমাম নাসিরুদ্দিন আলবানি (রহ.) তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘আস-সিলসিলাতুস সহিহাহ আল মুজাল্লাদাতুল কামিলাহ’ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডের ১১৪৪ নং অধ্যায়ের ২১৮ নম্বর পৃষ্ঠায় শবে বরাত সম্পর্কে হাদিস এনে যে মত ব্যক্ত করেছেন তা হলো-হজরত মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘অর্ধ শাবানের রাতে (শবে বরাতে) আল্লাহ তায়ালা তাঁর সব মাখলুকের প্রতি মনোযোগ আরোপ করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষভাবাপন্ন ব্যক্তি ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন’ (সহিহ ইবনে হিব্বান : ৫৬৬৫; ইবনে মাজা : ১৩৯০)। ইমাম আলবানি হাদিস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনা করে বলেন, সারকথা হলো, নিশ্চয়ই এসব হাদিস সূত্র পরম্পরা দ্বারা সহিহ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর সহিহ হওয়া এর থেকে কমসংখ্যক বর্ণনা দ্বারাও প্রমাণিত হয়ে যায়।

খালেদ / পোস্টকার্ড;