দানের হাত সহমর্মিতায় প্রসারিত হোক

দানের হাত সহমর্মিতায় প্রসারিত হোক

ইদরীস আল মুহারিব ।।

আসরের নামাজ শেষ করে বের হয়েছি আমি ও বন্ধু সালমান। অলস শরীর নিয়ে আনমনে হাঁটছি। আজ কোনো মার্কেটিং করার ইচ্ছা নেই। পকেটটাও প্রায় খালি। অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে আমরা সিটির গেটে পৌঁছি। গেট পেরুতেই কতগুলো ক্ষুধার্ত হাত একসঙ্গে প্রসারিত হলো। তিনজন ভিখারি। পঞ্চাশ পেরিয়ে প্রজ্জ্বল বার্ধক্য শুভ্র হয়ে দেখা দিয়েছে একজনের দাড়ি-মোচে। শৈশবের শুরু থেকেই বিষাদ চেখে জীবনের পথ চেনা সাত-আট বছরের আরেকটি শিশু। অপরজন জীবনের পরম-সঙ্গী স্বামীহারা এক পথ-বধূ। বয়সে আমার মায়ের সমান। তিনটি প্রাণের ছয়টি ক্ষীণ দৃষ্টি আমাকে যেন বলছিল আজ সকাল পেরিয়ে দুপুর, তারপর এখন পর্যন্ত এক লোকমা ভাতও পেটে জোটেনি। অনাহারে কিংবা অর্ধাহারে প্রতি বিকালেই হয়তো তারা এখানে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে এই পথ দিয়ে চলা ভদ্রলোকদের দিকে, তীব্র ক্ষুধার দায়ে বাড়িয়ে দেয় হাতখানা। এরকম ক্ষীণদৃষ্টি আর ক্ষুধার্ত চেহারাদের উপেক্ষা করে আমি কখনওই আসতে পারি না। ভেতর থেকে কিসের যেন বাধা আসে। মনে পড়ে যায় রাসুল (সা.)-এর বাণী। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ যে দিনই যাপন করে, ওই দিনের শুরুতে আসমান থেকে দুইজন ফেরেশতা অবতরণ করেন এবং বলেন হে আল্লাহ! প্রত্যেক দানশীলকে আপনি দানের বিনিময়ে অঢেল সম্পদ দান করুন। অপর ফেরেশতা বলেন, হে আল্লাহ! প্রত্যেক কৃপণ ব্যক্তির সম্পদে আপনি ধ্বংস অনিবার্য করুন।’ (বুখারি : ১৪৪২)
কিন্তু এখান থেকে মোহাম্মদপুর ত্রিশ টাকা রিকশা ভাড়া ছাড়া আমার পকেট যে একেবারেই খালি। ভাবছি আজ না হয় নাই দান করলাম। একটু দূর হেঁটে চলে এসেছি। কিন্তু চলে আসতে পারিনি। আমার মনে পড়ে গেল হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত মহান রব্বুল আলামিনের বাণীÑ ‘কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা বলবেনÑ হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে আহার করাওনি। বান্দা বলবেÑ হে রব! কীভাবে আমি আপনাকে আহার করাব? অথচ আপনি তো বিশ^জগতের প্রতিপালক! আল্লাহ বলবেন, তোমার কি মনে নেই যে আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল। কিন্তু তুমি তাকে খাবার দাওনি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে আহার দান করতে তাহলে তার প্রতিদান আমার কাছে পেতে!’ (মুসলিম : ২৫৬৯)
আমি আর কঠিন হতে পারিনি। ফিরে গিয়ে দশ টাকা করে তিনজনকে দান করি। আমি জানি আমার দান অনেক ছোট, অনেক ক্ষুদ্র। কিন্তু তাতেও আমার কোনো লজ্জাবোধ নেই। মনে পড়ে গেল নবীজির হাদিস। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ক্ষুদ্র জিনিসও দান করতে অপমানবোধ করো না। যদিও সেটা হয় ছাগলের খুর।’ (বুখারি : ৬১০৭)
আসলে দানশীলতা একটি মহৎ গুণ। সমাজে ধনী গরিবের বিষাদ বিভাজন নিরসন করে মধুর ভালোবাসা সৃষ্টির এক অনুপম প্রক্রিয়া। দানশীলরা প্রিয় আমাদের কাছে, সমাজের কাছে এবং আল্লাহর কাছে। দানশীলদের বহুগুণ পরিমাণ প্রতিদান লাভ হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছেÑ ‘আল্লাহর রাস্তায় দানকারীদের দান হচ্ছে এমন এক বীজের ন্যায়, যা থেকে উদ্গত হয় সাতটি শীষ, আর প্রতিটি শীষে থাকে শতাধিক শস্য। আর আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছা করেন প্রতিদান বহুগুণ বাড়িয়ে দেন।’ (সুরা বাকারা : ২৬১)। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছেÑ ‘যারা নিজেদের সম্পদ দান করে রাতে ও দিনে, প্রকাশ্যে ও গোপনে, তাদের জন্য রয়েছে নির্ধারিত প্রতিদান তাদের রবের কাছে। মহা-প্রলয়ের দিন তাদের কোনো ভয় থাকবে না এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে না।’ (সুরা বাকারা : ২৭৪)
দানের কথা শুনলেই অনেকে কঠিন কিছু মনে করেন। তারা ভাবেনÑ দুই টাকা, পাঁচ টাকা কি আর দান করা যায়! এভাবে তাদের আর দানই করা হয় না। আসলে বিষয়টি এমন নয়। আপনি দশ টাকার মালিক তো দুই টাকা দান করুন, পঞ্চাশ টাকার মালিক হলে পাঁচ টাকা দান করুন। আর একশ টাকার হলে ১০ টাকা দিন। এভাবেই আল্লাহর পথে দান করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
দানশীলের জন্য সবচেয়ে আনন্দদায়ক উত্তম পুরস্কার হলো তাকে আল্লাহর ঘনিষ্ঠ ও জান্নাতের নিকটবর্তী বলে ঘোষণা করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ‘দানশীল আল্লাহ তায়ালার ঘনিষ্ঠ, জান্নাতের নিকটবর্তী, সমাজে ভালোবাসার পাত্র, জাহান্নাম থেকে দূরবর্তী। আর কৃপণ দূরবর্তী আল্লাহর, জান্নাতের এবং দূরে সমাজের, নিকটবর্তী জাহান্নামের। কৃপণ ইবাদতগুজার বান্দার চেয়ে মূর্খ দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়।’ (বুখারি : ১৯৬১)
তাই আসুন প্রভুর ভালোবাসা ও নৈকট্যের তীব্র আকাক্সক্ষায় আজ থেকে আমরা দান করতে শুরু করি! দানকে প্রতিদিনের একটি অভ্যাসে গড়ে তুলি! সহমর্মিতায় ভরে দেই আমাদের জীবন, আমাদের সমাজ।