জাতীয় পতাকা উড়িয়েছি বিদেশের মাটিতে

জাতীয় পতাকা উড়িয়েছি বিদেশের মাটিতে
জাতীয় পতাকা উড়িয়েছি বিদেশের মাটিতে

জাকারিয়া পিন্টু ।।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভায় ৭ই মার্চ বললেন, তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা কর। তখন আমি মনে করলাম, আমার কাছে তো ফুটবল আছে। আমি ফুটবল দিয়ে টাকাও আনতে পারি আবার জনমতও তৈরি করতে পারি। তখন তো আমি ঢাকায়। অনেক কষ্টে স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে আসি আমার পৈতৃক বাড়ি নওগাঁয়। নওগাঁ থেকে ভারতের সীমান্ত প্রায় ৪৫ মাইল।

মনে করলাম, ভারতে চলে যাব। দেখি সেখানে গিয়ে একটি টিম করতে পারি কি না। তখন সেখানে ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা আব্দুল জলিল (প্রয়াত)। তিনি নওগাঁয় টেন্ট করে সেখানে ২০০ মুক্তিযোদ্ধার টিম করার দায়িত্ব দেন আমাকে। আমি তখন ট্রেনিংয়ে। কিন্তু মনের মধ্যে ঘুরপাক  খেত, আমি চলে যাব, ফুটবল দল গড়ব। এরই মধ্যে পাকিস্তানিরা নওগাঁ শহরে বোমা মারে। সেটা পড়ে নওগাঁর তাজ সিনেমা হলের সামনে। বুঝলাম, এখানে আর না।

কারণ ততদিনে আমার নাম ছড়িয়েছে। সঙ্গে এলাকায় রাজাকাদের দাপটও বাড়ছে। আমি চলে আসি বালুঘাট। এখানে একটা ক্যাম্প থেকে উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি এসব জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠানো হতো। আর্মস ট্রেনিং সম্পন্ন হওয়ায় আমি ওই ক্যাম্পের অ্যাডমিনেস্ট্রটর এবং ক্যাপ্টেন ছিলাম। এরই মধ্যে নজরুল ইসলাম সাহেব চিঠি পাঠিয়ে আমাকে লেখেন, ‘পিন্টু তুমি চলে আস। একটা টিম হচ্ছে।

তুমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়বে আর টাকা তুলে দেবে’। আমি বিয়ের রাতেও ফুটবল খেলতে চলে গিয়েছিলাম। চিঠি পাওয়ার পর, এটা মনে করিয়ে উৎসাহ দিল’। আমি চলে যাব কলকাতা। আমাদের লক্ষ ছিল, আমরা খেলে খেলে ক্রীড়া ফান্ডে টাকা দেব আর জনমত সৃষ্টি করব। এর আগেই আমরা বর্ডারে বর্ডারে জানিয়ে দিলাম, ‘একটা ফুটবল টিম হচ্ছে। যারা ফুটবল খেলে, তাদের আসার জন্য বলা হলো’। এ সময় আমাদের দলে ফুটবলারের সংখ্যা প্রায় ৪৫ জনে দাঁড়াল। ট্রায়ালের পরে ৩৫ জন প্লেয়ার সিলেক্ট হলাম। যেহেতু আমি সিনিয়র ছিলাম তাই আমাকেই অধিনায়ক করা হলো। আর প্রতাপ শঙ্কর হাজরা সহ-অধিনায়ক। প্রথম খেলা আমাদের ২৫ জুলাই। কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে, নদীয়া একাদশের বিপক্ষে।

ওই ম্যাচের আগে ওরা জানতে চাইল, আপনারা কী কী করবেন? সুযোগ বুঝে বললাম, তোমাদের পতাকার সঙ্গে পতাকা উড়াব এবং আমরা আমাদের পতাকা নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করব। সব জানিয়ে চিঠিও দিয়েছিলাম। ২৪ জুলাই আমরা সেখানে গেলাম। পরদিন খেলার জন্য বুট পরে প্রস্তুত। কিন্তু আমাদের জানিয়ে দেওয়া হলো, পৃথিবী আমাদের স্বীকৃতি দেয়নি। তাই আমরা পতাকা উড়াতে পারব না। এতে আমরা খেলতে অপারগতা জানাই। বিকাল সাড়ে পাঁচটা বাজার পরেও খেলা শুরু না হলে দর্শকরা ভাঙচুর শুরু করে। অধিকাংশই এসেছিলেন মেহেরপুর থেকে, বাংলাদেশের সমর্থক। তখন মিটিং করে সেখানকার ডিসি বিকে ঘোষ জানান, ‘আমরা ১০ মিনিটের জন্য পতাকা উত্তোলন করতে পারব’। আমরা রাজি হই। কারণ আমাদের ইচ্ছা ছিল, ওই মাঠেই আমরা স্বীকৃতি নিয়ে নেব।

আমরা বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করলাম এবং ভারতের পতাকা উড়ালেন ডিসি সাহেব। দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হলো। ব্যাস, ওইখানেই আমরা স্বীকৃতি পেয়ে গেলাম। দর্শকরা দাঁড়িয়ে বলল, জয় বাংলা এগিয়ে চল। দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে আমরাই প্রথম স্বীকৃতি নিয়ে এসেছি। আমাদের সবচেয়ে বড় গৌরব, আমরা বিদেশের মাটিতে পতাকা উত্তোলন করে স্বীকৃতি চেয়েছি। আমরা ১৬টি ম্যাচ খেলেছি। ৯টি জিতেছি, তিনটা ড্র এবং ৪টা হেরেছি। ১৬ ম্যাচ খেলে ৫ লাখ রুপি (ভারতীয় মুদ্রা) আয় করে মুক্তিযুদ্ধ ফান্ডে দিয়েছি আর জনমত তো অলরেডি করে ফেলেছি। যেখানেই যেতাম সেখানেই মানুষের ঢল নামত।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক