জিডিপি’র চিত্র পাল্টে যাবে যদি পরিবারের জন্য নারীর অবদানের মূল্যায়ন হয় - গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা

জিডিপি’র চিত্র পাল্টে যাবে যদি পরিবারের জন্য নারীর অবদানের মূল্যায়ন হয়  - গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা

" রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষ সমভাবে অংশগ্রহণ করতে পারলে সে রাষ্ট্র উন্নতির দিকে ধাবিত হয়। তাই নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে হবে। একজন নারী ঘরে এবং বাইরে কাজ করে। ঘরের কাজের কোন আর্থিক মূল্য থাকে না। বেশিরভাগ নারী নিজের কাজের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। পরিবারের জন্য যে কাজ করছে তার আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা উচিত। তাহলে আমাদের জিডিপি’র চিত্র অন্যরকম হবে। পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরকেও আরো সচেতন হতে হবে। পুরুষদের উচিত মা, স্ত্রী, বোন, বান্ধবীর কাজের সম্মান দেয়া। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন করতে হবে। সম্মান দিলে এমনিতেই নারীদের কাজে পুরুষেরা সহযোগিতা করবে। "

‘নারীর অমূল্যায়িত সেবা কাজের মূল্যায়ন এবং জিডিপিতে সেই কাজের সংযোজন’ শীর্ষক গোলটেবিল আালোচনা বক্তারা আজ এসব কথা বলেন ।

আজ শনিবার পূর্বকোণ সেন্টারের ইউসুফ চৌধুরী মিলনায়তনে দৈনিক পূর্বকোণ আয়োজিত এই গোলটেবিল আলোচনায় সহযোগিতা করে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।’

সভা সঞ্চালনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চবি সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. ওবায়দুল করিম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সাবেক সংসদ সদস্য সাবিহা মুছা, চবি প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া, দৈনিক প্রথম আলোর বার্তা সম্পাদক ওমর কায়সার, চট্টগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক শহীদুল ইসলাম, অর্গানাইজেশন ফর উইমেন এন্ড চিলড্রেন এডভান্সমেন্ট (ওকা) এর সেক্রেটারি জেনারেল খায়রুল আলম সুজন, কাউন্সিলর আফরোজা কালাম, চিটাগং উইমেন চেম্বারের পরিচালক রোজিনা আক্তার লিপি, মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ডা. সাগরিকা শারমিন, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক জয়নব তাবাসসুম বানু সোনালী, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের ডেপুটি গভর্নর আমিনুল হক বাবু, নারী কল্যাণ মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা ও আহবায়ক আরিকা মাইশা এবং ইপসার প্রজেক্ট ম্যানেজার ফারহানা ইদ্রিস। স্বাগত বক্তব্য রাখেন দৈনিক পূর্বকোণের সিনিয়র রিপোর্টার সাইফুল আলম। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’র মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশন কোঅর্ডিনেটর শাহানা হুদা।

সঞ্চালকের বক্তব্যে চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার বলেন, একদিন নারীর মাতৃতান্ত্রিক সমাজের মাধ্যমে স্বাধীন ছিল। বর্তমানে নারীরা সুঁই দিয়ে কাজ করা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন করছে। তারপরও নারী তার ইপ্সিত জায়গায় কি পৌঁছতে পেরেছে এমন প্রশ্ন তুলে বলেন, আমরা কি কখনো ভেবেছি, আমাদের সমাজে মা-বোন এবং গৃহবধূরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে পরিবার এবং সমাজকে ঠিক রাখার জন্য। যে নারীরা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তাদের ভূমিকা জিডিপি’তে সংযোজন হচ্ছে না। বয়স্ক হলে নারীদের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। সামান্য ওষুধ কেনার সামর্থ্যও থাকে না। পরিবর্তনের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত। সব নারীকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। সমাজের মূল্যবোধটাকেও টিকিয়ে রাখতে হবে। মা-বাবার সেবার মূল্যায়ন কখনোই সম্ভব নয় সত্য। কিন্তু সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। যে মা সেবা দিচ্ছেন তারা অত্যন্ত সম্মানের জায়গায় থাকবেন। পাশ্চাত্যে যে হাহাকার উঠেছে তাদের পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। আমরা এখনো ভাল আছি। তবে কিছুটা আঁচ আমাদেরও লেগেছে।

প্রফেসর ড. ওবায়দুল করিম বলেন, নারীর সেবাকে পণ্যে রূপান্তরিত করে সেটাকে মূল্যায়ন করতে হবে। আমাদের দেশে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নারীরা কাজ করে। কিন্তু এগুলোর কোন মূল্যায়ন নেই। নারীকে উত্তরাধিকার আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিশ্বাস পরিবর্তন হয়, উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন হয়, চিন্তা-চেতনা পরিবর্তন হয়, এটা বাস্তব। এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হচ্ছে বোকামি। সেজন্য আমাদের সমাজেও এখন কর্র্তৃত্ববাদ আছে। এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বেগম রোকেয়ার মত নারীনেত্রীর জন্ম নিতে হবে। মানুষের চিন্তার কাঠামো গঠন হয় সময়কালের সমাজের উপর ভিত্তি করে। সমাজে যেসব মতবাদ আছে তা কোন না কোনভাবেই পুরুষ কর্তৃত্ব করে। এর সংশোধন প্রয়োজন। তার জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে মুক্তির উপায় খোঁজা দরকার। যে জিনিসের বিনিময় মূল্য নেই। তার মূল্যায়ন হয় না। নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে না পারলে সম্প্রদায় হিসেবে তাদের মুক্তি আসবে না। সরকার চেষ্টা করেছে উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন করার জন্য, পারেনি। দাসরা যতদিন বিশ্বাস করেছে এটাই তাদের নিয়তি ততদিন তারা মুক্ত পায়নি। যেদিন বিশ্বাস পরিবর্তন হয়েছে সেদিন থেকে তারা মুক্ত হয়েছে। পৃথিবীতে কোন সামাজিক পরিবর্তন ব্যক্তির ভূমিকা ছাড়া হয়নি।

সাবিহা মুছা বলেন, ছোটবেলা থেকেই বৈষম্য দেখে আসছি। নারী-পুরুষ, শাশুড়ি-বউয়ের বৈষম্য। আমরা এর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছি। একটা শিক্ষিত মেয়ের হাতে যদি অর্থ না থাকে তাহলে সে পুরুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকবে। সেটাই বাস্তবতা। তাই নারীদের আগে শিক্ষিত করতে হবে। শিক্ষিত হলে তাদের হাতে অর্থও আসবে। পরিবারের কাজের বিনিময়ের মূল্যটা নির্ধারণ না করে তার ইচ্ছেমত খরচ করার টাকা দিতে হবে। আগে নারীকে আর্থিক স্বাবলম্বী করতে হবে।

প্রফেসর ড. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, আমাদের দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এই নারী সমাজকে বাদ দিয়ে কখনো আমাদের দেশের কাক্ষিত উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব না। নারী সমাজ ছাড়া এগিয়ে যাওয়া সম্ভব না।

সূত্রঃ পূর্বকোণ