চট্টগ্রামে ভয়ানক সরকারি জমি দখলচিত্র , রক্ষকরাই যেখানে ভক্ষক

পোস্টকার্ড প্রতিবেদক ।।

চট্টগ্রামে ভয়ানক সরকারি জমি দখলচিত্র , রক্ষকরাই যেখানে ভক্ষক

পাহাড়, জমি দখল করে ভূমিদস্যুদের জমিদারি সহ ক্ষমতার দাপটে ধনকুবের বনেছে ভূমিদস্যু চক্র । মাঠে নেমেছে দুদক ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী । দুদকের তালিকায় রয়েছেন কয়েকজন কাউন্সিলর সহ জড়িত আছেন সরকার দলীয় ও বিএনপি নেতাও । পাহাড়, সরকারি-বেসরকারি জায়গা-জমি দখল করে লুটেপুটে খাচ্ছে এক শ্রেণির ভূমিখেকো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে দোর্দ- প্রতাপে ‘ধনকুবের’ বনেছে ভূমিদস্যু চক্র। এই চক্রের অধিকাংশই জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে রক্ষকরাই ভক্ষকে পরিণত হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে এসব অপকর্ম চলে আসলেও তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে পাহাড়খেকো, অবৈধ দখলদারদের চিত্র উঠে এসেছে। চলমান অভিযানে ভূমিদস্যু, অবৈধ সম্পদের মালিক ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন গোয়েন্দা সংস্থা ও দুদক। সরকার প্রধানের নির্দেশনায় পরিচালিত অভিযানে মহানগরীর ভূমিখেকো, রাঘব-বোয়াল ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি নগরবাসীর। দুদক সূত্র জানায়, কয়েকজন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে দখলবাজি ও চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ার তথ্য রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ ও ব্যবস্থা নিতে মাঠে নেমেছে সরকারের বিভিন্ন বাহিনী। এছাড়াও কয়েকজন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে আসছে দুদক। গত ১৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশনের গণশুনানিতে এসব বিষয়েও কয়েকটি অভিযোগ জমা পড়ে। কাউন্সিলর ছাড়াও নগরীর বিভিন্ন স্থানে সরকার দলীয় কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধেও দখলবাজির অভিযোগ রয়েছে। দখলবাজির তালিকায় বাদ পড়েনি বিএনপিও। একাধিক স্থানে বিএনপি দলীয় নেতারা জড়িত রয়েছেন।

দুদক সূত্র জানায়, এসব কাউন্সিলররা রাতারাতি ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’ হয়ে গেছেন। সরকারি জায়গা দখল ও অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। তাদের মধ্যে আবার একাধিক কাউন্সিলর কর্পোরেশনের ডোর টু ডোর কার্যক্রমের নামে প্রতিটি বাসা থেকে অর্থ আদায়ের মতো অভিযোগ রয়েছে। কয়েকজন কাউন্সিলর স্ত্রী-সন্তানের নামেও গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। যা দুদকের অনুসন্ধানে ওঠে আসছে।

দেখা যায়, লালখান বাজারের মতিঝর্ণা ও বাটালি হিলে পাহাড় দখল করে অবৈধভাবে গড়ে ওঠেছে শত শত বস্তিঘর। পাহাড় দখল, পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হয়েছে ঘরবাড়ি ও বহুতল ভবন। দখলের তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন সরকার দলীয় এক কাউন্সিলর ছাড়াও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র নেতৃত্ব স্থানীয় একাধিক নেতা। রেলওয়ে ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের পাহাড় লুটে খেলেও সরকারি সংস্থা দুটি যেন ভূমিদস্যুদের কাছে অসহায় ছিল। এমনকি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে গিয়ে বার বার বাধার মুখে পড়েছে জেলা প্রশাসন। এমনকি সড়ক অবরোধ করে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র স্থানীয় শীর্ষ দুই নেতা। একজন মহিলা কাউন্সিলরও মাঠে ছিলেন। অক্সিজেন ও বায়েজিদ শিল্প এলাকা, আমিন জুট মিল, ষোলশহর এলাকায়ও পাহাড় ও জায়গা-জমি দখল-বেদখল হচ্ছে নির্বিঘ্নে। বায়েজিদ, অক্সিজেন, আরেফিন নগর, চন্দ্রনগর, বাংলাবাজার, পূর্ব ষোলশহর এলাকাবাসী জিম্মি সন্ত্রাসীদের কাছে। ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে জায়গা ক্রয়, শিল্প-কারখানা মালিকদের প্রতিনিয়ত চাঁদা দিতে হয়। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজি ভাগবাটোয়ারা নিয়ে হয়েছে খুনোখুনির ঘটনা। এসব কারণে ২০১৫ সালে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে খুন হন যুবলীগের মেহেদী হাসান বাদল। মেহেদী খুনের পর অপরাধ সা¤্রাজ্য প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপ যুবলীগের দুই নেতার কবজায় চলে যায়। নাসিরাবাদ, টেক্সটাইল, বাংলা বাজার, পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট এলাকার পাহাড় দখল করে সাম্রাজ্য গড়েছে ক্ষমতাসীন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নামধারী কয়েকজন।
আমিন জুট মিল, শান্তিনগর থেকে পোড়া কলোনি, মোহাম্মদনগর, আতুরার ডিপো এলাকায় চলছে জুট মিলের জায়গা দখল, পাহাড় দখল-কাটা, দখল স্বত্ব বিক্রি, সরকারি জায়গা দখলের মহোৎসব।

বিআরটিএ’র দালাল চক্র নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে টেন্ডারবাজি নেপথ্যে বার বার গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছেন এক কাউন্সিলর।
পাহাড়তলী এলাকায় রেলের জায়গা-জমি দখল করে বাড়ি, মার্কেট ও বস্তিঘর নির্মাণ করে সাম্রাজ্য গড়েছেন ‘রেল সম্রাট’ খ্যাত সরকার দলীয় এক কাউন্সিলর। রেলের জায়গা দখল ও বিক্রি করে কোটিপতি হয়েছেন তিনি।
পাহাড়তলী, আকবর শাহ এলাকায় পাহাড় কেটে রীতিমতো আবাসন গড়েছেন সরকার দলীয় এক নেতা। তিনিও ওয়ার্ড কাউন্সিলর। তার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলা রয়েছে। একইভাবে নগরীর গোলপাহাড় মোড় এলাকায় পাহাড় কেটে বহুতল মার্কেট নির্মাণ করার অভিযোগ রয়েছে এক কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। জায়গার বিরোধ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের নোটিশ-মামলা আমলে না নিয়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ৬তলা বিশিষ্ট মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে। আইনের কোনো তোয়াক্কা না করে ক্ষমতার দাপটে প্রকাশ্যে পাহাড় কেটে মার্কেট নির্মাণ করা হয়।

ইপিজেড শিল্পজোন এলাকায় পুরোনো কাপড় থেকে শুরু করে চোরাই পণ্য নিয়ন্ত্রণ করছে এক নেতা। তিনিও সরকার দলীয় কাউন্সিলর। ফুটপাত থেকে শুরু করে শিল্প এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য ও টেন্ডার-ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করে কাউন্সিলরের অনুসারীরা।
এ কে খান গেট ও কাট্টলী এলাকায় জায়গা দখল, সন্ত্রাস, অর্থ আত্মসাৎ ও বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগের নাম রয়েছে এক কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জায়গা দখল, এতিমখানার নামে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সড়ক পরিবহনের সরকারি খাস জায়গা দখল করে কমিউনিটি সেন্টার ও দোকান, খালের উপর অবৈধ স্থাপনা নির্মাণসহ শিল্প-কারখানা থেকে চাঁদা আদায়ের নানা অভিযোগ রয়েছে।

জামালখান, এনায়েত বাজার ও আশপাশ এলাকার দুই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য রয়েছে বলে দুদক সূত্র জানায়। আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা, সিজিএস কলোনি, পাঠানটুলী এলাকায় ফুটপাত থেকে চাঁদা আদায় থেকে শুরু করে টেন্ডারবাজি, দখল-বেদখলের অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের।
কর্ণফুলী নদীর তীরে জেগে ওঠা চরের জায়গা দখল করে ফিরিঙ্গীবাজার এলাকায় প্রাসাদ নির্মাণ করেছেন এক বাস্তুহারা নেতা। কর্ণফুলী নদী ড্রেজিং-এ তীর ভরাট করে গড়ে তুলেছে বাস্তুহারা নামে বিশাল বস্তি। বস্তি সা¤্রাজ্য গড়ে তোলে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তিনি। এর নেপথ্যে রয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের পদধারী এক নেতা। তিনিও কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ওই নেতার নেতৃত্বে যুব-ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ চাক্তাই, রাজাখালী, বাস্তুহারা বস্তি ও নতুন ব্রিজ এলাকায় দখল-বেদখল, চাঁদা আদায় ও ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত বলে সূত্র জানায়।

বাকলিয়া বাস্তুহারা বস্তি ছাড়াও চাক্তাই ভেড়া মার্কেট বস্তি এবং চাক্তাই-রাজাখালী খালের মোহনায় গড়ে বিশাল মৎস্য বাজার। বন্দর থেকে নদীর তীরের জায়গা লিজ নিয়ে এই মাছ বাজার গড়ে ওঠেছে। ইজারার বাইরের অংশ দখল করে হিমাগার ও বরফ কল নির্মাণ করা হয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে, এর নেপথ্যে রয়েছে নগর আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা। তার ইন্ধনে নদীর তীর দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। নদ-নদী দখলের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর নির্দেশনা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। এছাড়াও কর্ণফুলী নদীর তীরে স্থাপনা নির্মাণের বিষয়ে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। তা অমান্য করে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।

সুত্রঃ পূর্বকোণ