গুলশান হামলা :জঙ্গিবাদ নির্মূলের টার্নিং পয়েন্ট , বিদেশিদের হত্যা করা হয়েছিল আলোচনায় আসতে

গুলশান হামলা :জঙ্গিবাদ নির্মূলের টার্নিং পয়েন্ট , বিদেশিদের হত্যা করা হয়েছিল আলোচনায় আসতে

আলমগীর হোসেন , সময়ের আলো ।।

চারদিকে কেবল লাশ আর লাশ। ভয়াবহ নৃশংসতা। গোটা রেস্তোরাঁর মেঝেতে বইছিল যেন রক্তের স্রোতধারা। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় সেদিন বর্বরতার চরম শিখরে উঠেছিল জঙ্গিরা। এ ঘটনার প্রায় সাড়ে তিন বছর পরও সেই নৃশংসতা ভোলেনি কেউ। ভয়ঙ্কর সেই স্মৃতি এখনও তাড়া করে গুলশান-২ এলাকার বাসিন্দাদের। এ ঘটনায় কেবল বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বই সেদিনের নৃশংসতায় কেঁপে উঠেছিল। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের টার্নিং পয়েন্ট গুলশানের হলি আর্টিজান হামলা। যে হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গিরা তাদের সংঘবদ্ধ তৎপরতা ও সক্ষমতার জানান দিয়েছিল। তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও জঙ্গিবাদ দমনে অভিযান সংক্রান্ত নতুন কর্মকৌশল আবিষ্কার এবং প্রয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় গুলশান হামলা।

এ প্রসঙ্গে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে যাদের যে ভূমিকা ছিল, সেগুলো আমরা চার্জশিটে উল্লেখ করেছি। আমরা সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে আদালতে প্রেরণ করেছি। আশা করছি, একটা ভালো রায় পাব।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, এই রায় একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। আইনের মাধ্যমে প্রমাণিত হবে যে, জঙ্গিদের ওই কার্যক্রম জঘন্য অপরাধ ছিল। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ দেখা গেছে। ভালো রায় পাওয়া যাবে বলেই আশা করা যায়। আর সেই রায়ের মাধ্যমে জঙ্গি কফিনে আরেকটি পেরেক মারা হবে।
তিনি বলেন, জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানের টার্নিং পয়েন্ট ছিল গুলশান হামলা। কেননা এমন এক পরিস্থিতির জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। কেউ এমনটি কখনও প্রত্যাশাও করেনি।

আবদুর রশিদ বলেন, বাংলাদেশ জঙ্গিবাদ দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। জঙ্গিবাদকে অনেক দেশে রাজনৈতিকভাবে দেখা হয়, কিন্তু বাংলাদেশে তা হয় না। জঙ্গিবিরোধী বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান বিশ্বের কাছে অনুকরণীয়। এই অভিযানের পরই পুলিশি অভিযানে হলি আর্টিজান হামলার মাস্টার মাইন্ড তামিম চৌধুরী নিহত হয়। আরও অনেকেই ক্রমাগত অভিযানে নিহত হয়েছে। এটা অন্য দেশের জন্য অনুকরণীয়। বর্তমানে তাদের মেরুদন্ড দুর্বল হয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এই জঙ্গিবিরোধী মনোভাব ও কঠোর নজরদারি বজায় রাখতে হবে।

সেদিন যা ঘটেছিল : ২০১৬ সালের ১ জুলাই। এ রাতেই রাজধানী ঢাকার অভিজাত গুলশান-২ এলাকায় হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। রমজান মাসের রাত। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছিল। গুলশানসহ আশপাশের এলাকায় তখন এক ভুতুড়ে পরিবেশ। থমথমে চারদিক। মাঝেমধ্যে গর্জে উঠছিল গুলি ও গ্রেনেড। বিকট আওয়াজে প্রকম্পিত হচ্ছিল পুরো এলাকা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাজার হাজার সদস্য বিভিন্ন পয়েন্টে কড়া অবস্থান নেন। এরই মাঝে দুজন পুলিশ কর্মকর্তা এসি রবিউল করিম ও ওসি সালাহউদ্দিন নিহত হওয়ার খবর জানাজানি হয়। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা চরমে। তার মাঝেই ওই হলি আর্টিজানে জঙ্গিদের জিম্মিদশায় থাকাদের আর্তনাদে বাইরের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠছিল। রাতের কোনো এক পর্যায়ে জঙ্গিরা হলি আর্টিজানে ২০ জনকে হত্যা করে। যাদের মধ্যে ৯ জন ইতালিয়ান নাগরিক, ৭ জন জাপানি, ৩ জন বাংলাদেশি এবং ১ জন ভারতীয় নাগরিক। এ ছাড়া অভিযান চালাতে গিয়ে জঙ্গিদের হামলায় দুজন পুলিশ কর্মকর্তাও প্রাণ হারান। এভাবে রাত গড়িয়ে ভোর হয়। থমথমে চারদিক। পুলিশ ও র‌্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তারা সারা রাত সেখানেই পার করেন। এর মাঝেই যুক্ত হয় সশস্ত্র বাহিনী। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয় কমান্ডো অপারেশন পরিচালনার। অপারেশনের নাম দেওয়া হয় ‘থান্ডারবোল্ট’। পরে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে হামলাকারী ৫ জনও প্রাণ হারায়। পরে ঘটনাস্থল থেকে আরও একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। যাকে পরবর্তী সময়ে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর কর্মচারী হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছিল। পৃথিবী জুড়ে আলোচিত জঙ্গিদের এই হত্যাযজ্ঞের তদন্ত শেষে গত বছরের ২৩ জুলাই আট জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ।

পুলিশ জানিয়েছে, হলি আর্টিজান হামলার পর দেশজুড়ে জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরের দুই বছরে ১৮টি অভিযানে মারা যায় ৭৯ জঙ্গি। গ্রেফতারও হয় অনেকে। এসব অভিযানে আপাতত সাফল্য পাওয়া গেছে। জঙ্গিরাও কিছুটা কোণঠাসা।

গুলশান হামলায় জড়িতরা : পুলিশ জানিয়েছে, হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা মামলার তদন্তে ঘটনার সঙ্গে মোট ২১ জন জড়িত ছিল। এর মধ্যে ঘটনার দিন ও পরে মোট ১৩ জনই বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছে। বাকি ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে। তবে এই হামলার ঘটনার পর আটক হওয়া ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। হলি আর্টিজানে হামলাকারীরা সবাই উচ্চশিক্ষিত, ধনী পরিবারের সন্তান ছিল।
চার্জশিটে যাদের অভিযুক্ত করা হয় : চার্জশিটে অভিযুক্তরা হলো রাকিবুল হাসান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাশেদুল ইসলাম, সোহেল মাহফুজ, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, হাদিসুর রহমান সাগর, মামুনুর রশীদ রিপন ও শরীফুল ইসলাম খালেদ।

অন্য অভিযানে নিহত আটজন হলো : তামিম চৌধুরী, মারজান, সারোয়ার জাহান মানিক, বাশারুজ্জামান, তানভীর কাদেরী, তারেক রায়হান ও ছোট রায়হান।

অপারেশন থান্ডারবোল্ডে নিহত জঙ্গিরা : রোহান ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল, সামিউল মোবাশ্বির, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও নিবরাস ইসলাম।

হলি আর্টিজান কেন টার্গেট : পুলিশ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলেছেন, গুলশান হামলার আগেই জঙ্গিরা আরও কয়েকটি জায়গা রেকি করেছিল। কিন্তু তাদের হিসাবে দেখেছে হলি আর্টিজানে নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলতে তেমন কিছু ছিল না। দ্বিতীয়ত এ জায়গা থেকে তাদের হামলা শেষে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার সুবিধা হবে। এ ছাড়া এখানে সর্বোচ্চ সংখ্যক বিদেশি একসঙ্গে পাওয়া যাবে। এসব কারণেই ঘটনার দুই থেকে তিন দিন আগে তারা হলি আর্টিজানকে হামলার জন্য চূড়ান্ত করে।