খুলে গেল স্বপ্নের সেতুর দুয়ার - এসএম আলমগীর

খুলে গেল স্বপ্নের সেতুর দুয়ার - এসএম আলমগীর
খুলে গেল স্বপ্নের সেতুর দুয়ার - এসএম আলমগীর

এসএম আলমগীর জাজিরা ও শিবচর প্রান্ত থেকে।।

একটি সেতুকে ঘিরে কত প্রতীক্ষা, কত উন্মাদনা। সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবেশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। খুলে গেল স্বপ্নের দুয়ার। উদ্বোধন করা হয় জাতির গর্বের প্রতীক পদ্মা সেতুর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার সকালে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে বাটন চেপে উদ্বোধন করেন পদ্মা সেতুর। এর মধ্য দিয়ে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্মোচন হয়েছে নতুন দিগন্তের, যা পাল্টে দেবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার অর্থনীতি, পাল্টে দেবে এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য।

পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘিরে পদ্মার মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে শনিবার ছিল উৎসবের আমেজ। ইতিহাসের সাক্ষী হতে নদীতীরে সমবেত হয় বিভিন্ন জেলার লাখো মানুষ। ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে মাওয়া থেকে জাজিরাÑ দুই প্রান্তেই আয়োজন করা হয় বিশেষ অনুষ্ঠানের। মাওয়া প্রান্তের সুধী সমাবেশ দিয়ে শুরু, মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা এবং শিবচরের কাঁঠালবাড়ীতে জনসমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয় উদ্বোধনী পর্ব। সমাবেশে কয়েক লাখ মানুষ অংশ নেন। উভয় প্রান্তের অনুষ্ঠানেই বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সকাল ৯টার আগে থেকেই মাওয়া প্রান্তের সুধী সমাবেশে আমন্ত্রিত অতিথিরা অনুষ্ঠানস্থলে আসতে শুরু করেন। ১০টার আগেই আসন গ্রহণ করেন তারা। সুধী সমাবেশে সরকারের মন্ত্রী, স্পিকার, রাজনীতিবিদ, কূটনৈতিক, শিক্ষাবিদসহ বিশিষ্টজনরা অংশ নেন। ১০টায় অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সুধী সমাবেশের বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে, ষড়যন্ত্রের জাল ছিঁড়ে আজ পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হয়েছে। এই সেতু শুধু সেতু নয়, শুধু ইট-সিমেন্ট-কংক্রিটের কাঠামো নয়, এই সেতু আমাদের অহঙ্কার, আমাদের গর্ব। সক্ষমতার, মর্যাদার প্রতীক।’ এ সময় দেশের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু প্রকল্পের জমকালো উদ্বোধন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী স্মারক ডাকটিকেট, স্যুভেনির শিট, উদ্বোধনী খাম এবং বিশেষ সিলমোহর উন্মোচন করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০০ টাকার বিশেষ স্মারক নোট উন্মোচন করেন।

এর আগে সুধী সমাবেশের শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। সভাপতির বক্তব্য দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে শিল্পকলা একাডেমি ও পদ্মা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষ নির্মিত থিম সং পরিবেশন করা হয়। চলচিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর এবং পদ্মা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষ নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।

সুধী সমাবেশ শেষে প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর মাওয়া প্রান্তের সেতুর ফলকের স্থানে এগোতে থাকে। প্রথম যাত্রী হিসেবে টোল দিয়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমেও প্রধানমন্ত্রী আরেক ইতিহাসের অংশ হয়ে যান। বেলা ১১টা ৪৮ মিনিটে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে তার গাড়ির জন্য ৭৫০ টাকা এবং বহরের সব গাড়ি মিলিয়ে মোট ১৬ হাজার ৪০০ টাকা টোল দেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর সেতু উদ্বোধনের জন্য ফলকের স্থানে যায়। সেখানে প্রধানমন্ত্রীসহ অতিথিরা গাড়ি থেকে নামেন এবং ফলক স্থানে প্রথমে মোনাজাত করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম মোনাজাত পরিচালনা করেন। দুপুর ১২টার একটু আগে সুইচ টিপে সেতুর ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। এর মাধ্যমেই খুলে যায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগের সড়ক পথের দুয়ার।

সেতু উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মশিউর রহমান, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক সেতুসচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া প্রমুখ। প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদও এ সময় সঙ্গে ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী সেতুর ফলক উন্মোচনের পাশাপাশি ফলকের স্থানে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার ম্যুরাল উদ্বোধন করেন। এ সময় আকাশে রঙিন ধোঁয়া ওড়ানো হয়। প্রধানমন্ত্রী নিজে ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগান দেন। উপস্থিত সবাই হাততালি দেন।

উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী গাড়িবহর নিয়ে মাওয়া পয়েন্ট থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। এ সময় মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সঙ্গে ছিলেন। আজ রোববার সকাল থেকে টোল দিয়ে সাধারণ যানবাহন চলাচল শুরু করবে সেতু দিয়ে।

জাজিরার দিকে যাওয়ার পথে দুপুর ১২টা ১২ মিনিটের দিকে গাড়ি থামিয়ে নেমে যান প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন পদ্মা সেতু অতিক্রম করেন, তখন বিমানবাহিনীর ছয়টি হেলিকপ্টার তাকে অভিবাদন জানায়। পদ্মা সেতুতে দাঁড়িয়ে তিনি বিমানবাহিনীর মহড়া দেখেন। এরপর দুপুর ১২টা ২৬ মিনিটের দিকে তিনি আবার গাড়িতে ওঠেন। সেখান থেকে তিনি জাজিরা প্রান্তে পৌঁছান। জাজিরা প্রান্তেও দুপুর ১২টা ৩৮ মিনিটের দিকে ‘পিতা ও কন্যা থিম’-এর ম্যুরাল-২ ও সেতুর ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে সেখানে মোনাজাত হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত ও জাজিরার নাওডোবা প্রান্তের উদ্বোধন কার্যক্রম শেষে কাঁঠালবাড়ির জনসভাস্থলে পৌঁছান। এরপর মঞ্চে বাজানো হয় বাংলাদেশের লোকগানের অনন্য স্রষ্টা আবদুল লতিফের লেখা ও মরমি শিল্পী আবদুল আলীমের গাওয়া ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী’ গানটি। এরপর বাজানো হয় ‘ও নদীরে, একটি কথা সুধাই শুধু তোমারে’ গানটি। এরপর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ‘জয় বাংলা’ সেøাগানে জনসভাস্থল মুখরিত হয়ে ওঠে।

বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারগুলো কাঁঠালবাড়ি ঘাটে মঞ্চের ওপর দিয়ে চক্কর দেয়। এর একটিতে জাতীয় পতাকা, একটিতে বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত পতাকা, একটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবিসংবলিত পতাকা, একটিতে পদ্মা সেতুর ছবিসংবলিত পতাকা ও আরেকটিতে আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকা বহন করা হচ্ছিল। আরেকটি হেলিকপ্টার থেকে ফুল ছিটিয়ে জনসভায় আসা লোকজনকে অভিবাদন জানানো হচ্ছিল।

এ সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজ আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের জন্য বিশেষ দিন। আমরা কিছুক্ষণ আগেই মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করে আসলাম। আপনারা জানেন, ২০০১ সালে এই পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলাম। পরে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে পদ্মা সেতুর কাজ বন্ধ করে দেয়। ২০০৯ সালে আমরা আবার ক্ষমতায় এসে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিই। কিন্তু তখন বিএনপি বলেছিল, আওয়ামী লীগ নাকি পদ্মা সেতু করতে পারবে না। এখন আমি খালেদা জিয়াকে জিজ্ঞেস করতে চাইÑ দেখে যান পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়েছে কি না। আমাদের দেশে অনেক জ্ঞানী-গুণী লোক, অর্থনীতিবিদ, আমলাÑ সবাই তখন বলেছিলেন, নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব নয়। তাহলে নিজেদের টাকায় আমরা কীভাবে করতে পারলাম পদ্মা সেতু। বাংলাদেশের জনগণ আমাদের সমর্থন দিয়েছে বলেই এই সেতু আমরা গড়তে পেরেছি। জনগণের শক্তি সবচেয়ে বড় শক্তি। তাদের শক্তিবলেই আমরা সেতু করতে পেরেছি।

দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা শেষ করে জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে মঞ্চ থেকে নেমে যান। সঙ্গে সঙ্গে সমাবেশে আসা লাখো জনতাও হাঁটা দেন যার যার গন্তব্যে। শেষ হয় পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। তবে সন্ধ্যার পর কাঁঠালবাড়ি ঘাটের মঞ্চে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। অনুষ্ঠান চলবে আরও কয়েক দিন।

ভাগ্য বদলাবে ২১ জেলার মানুষের : পদ্মা সেতুর কল্যাণে এখন এ এলাকায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে। শিল্প-কলকারখানা হবে। কৃষকের উৎপাদিত ফসল প্রক্রিয়াজাত করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানিও করা যাবে। মাছ প্রক্রিয়াজাত করে রফতানি করা যাবে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে ২১টি জেলার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে, দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। - সময়ের আলো ।

খালেদ / পোস্টকার্ড ;