আমার বয়স এখন ৭৩, ছুটির দরকার ছিল: নতুন ইতিহাস নির্মাতা শেখ হাসিনা

আমার বয়স এখন ৭৩, ছুটির দরকার ছিল: নতুন ইতিহাস নির্মাতা শেখ হাসিনা
আমার বয়স এখন ৭৩, ছুটির দরকার ছিল: নতুন ইতিহাস নির্মাতা শেখ হাসিনা

হাবীব রহমান।।

চলতে চলতে ইতিহাসের পাতায় চিহ্ন এঁকে যাচ্ছেন। এর চেয়ে বড় সত্যি হচ্ছে- বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার পথচলাটাই একটা ইতিহাস। নির্মমতার প্রেক্ষাপটে সাহসিকতা ও নিষ্ঠা আর পোড়া মাটিতে সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণের ইতিহাস। বাংলাদেশের গোড়াপত্তনের ইতিহাসের যিনি সাক্ষী, সেই শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণ করে চলছেন বিশ্বময়। আর ইতিহাস যাকে ধারণ করে তার ছুটি হয় না।

শনিবার টানা নবমবারের মতো আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়লেন শেখ হাসিনা।সাড়ে ৩৮ বছর ধরে দলের সভাপতি পদে থাকার ইতিহাস আর কোনো রাজনীতিবিদের নেই। শনিবার দলের ২১তম জাতীয় কাউন্সিলে আবারও সভাপতি নির্বাচিত হয়ে আরও তিন বছরের জন্য দায়িত্ব পেলেন তিনি। বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগের ৭০ বছরের ইতিহাসে অর্ধেকের বেশি সময় তথা ৩৮ বছর ধরে দলের সভাপতির দায়িত্ব ভার শেষ করে এরই মধ্যে ইতিহাস রচনা করেছেন। নতুন করে আরও তিন বছরে জন্য দায়িত্বভার নিয়ে সে অর্জনকে দীর্ঘায়িত করলেন।

১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে দলের ত্রয়োদশ সম্মেলন থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি। তার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ আজ মহিরুহ হয়ে, দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয়েছে। চারবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসেছে। এর আগে বেশ কয়েকবার দলীয় অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সভাপতির পদ ছাড়ার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তবে ‘বিকল্প নেই’ বলে শনিবার একুশতম সম্মেলনেও তাকেই সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।

নবমবারের মতো আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘আমি চাচ্ছিলাম, আমাকে একটু ছুটি দেবেন। আপনাদের ভাবতে হবে, আমার বয়স হয়ে গেছে। আমার বয়স এখন ৭৩। এবারও আমাকে দায়িত্ব দিয়ে দিলেন আপনারা।’

আবেগতাড়িত হয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালে মা-বাবা-ভাই-বোন সব হারিয়েছি। আপনজন যাদেরকে রেখে গিয়েছিলাম তারা আর কেউ নেই। আওয়ামী লীগকে আমার পরিবার হিসেবে নিয়েছি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ভালোবাসাই ছিল আমার চলার শক্তি।’ তিনি বলেন, ‘আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন সে দায়-দায়িত্ব যেন সঠিকভাবে পালন করতে পারি। আমার একটাই লক্ষ্য, তার সেই আকাঙ্খাটা পূরণ করা। স্বপ্নটা পূরণ করা। ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা, যেন অন্তত আমার বাবা-মায়ের আত্মাটা শান্তি পায়। আর লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের যে স্বাধীনতা, সেটা যেন বৃথা না যায়, সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

১৯৮১ সালের ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারির সম্মেলনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এরপর ১৯৮৭ সালের জানুয়ারিতে চতুর্দশ, ১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বর পঞ্চদশ, ১৯৯৭ সালের মে মাসে ষোড়শ, ২০০২ সালের ডিসেম্বরে সপ্তদশ, ২০০৯ সালের জুলাইয়ে অষ্টাদশ, ২০১২ সালের ডিসেম্বর ঊনবিংশ, ২০১৬ সালের অক্টোবরে বিংশতম এবং শনিবার ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে একবিংশতম সম্মেলনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন হাসিনা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে যেদিন সপরিবারে হত্যা করা হলো সেদিন স্বামী ওয়াজেদ আলী মিয়ার কর্মযোগে তিনি ছিলেন দেশের বাইরে।

নয়ত নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার তাকেও হতে হতো। প্রাণে বেঁচে যাওয়া মানুষটি এরপর শত ঘাত-প্রতিঘাতের মুখে পড়েছেন। প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন। এর পরপরই তার হাতে তুলে দেওয়া হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাল। সেই থেকে তিনি দলের প্রধান।

একটা দল এবং দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে বিশ্বের যে ক’জন নেতা দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন, নেতা থেকে হয়ে উঠেছেন বিশ্বনেতা, সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান থেকে হয়ে উঠেছেন রাষ্ট্রনায়ক, তাদের সারিতে শেখ হাসিনা তার স্থান করে নিয়েছেন আরও আগেই।

সাম্প্রতিক বিশ্বে যে ক’জন নেতার নাম বিভিন্ন কারণে বার বার উচ্চারিত হয়, তাদের মধ্যেও তিনি রয়েছেন। গত এক দশক ধরে বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যম, সংগঠন, সংস্থাগুলো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সন্দেহাতীতভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর, প্রভাবশালী, মানবিক ও সৎ সরকার প্রধান হিসেবে গণ্য করে আসছে। সেই নেতাকে টানা নবমবারের মতো দলের সভাপতি নির্বাচন করেছে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলররা।

ভারতের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কংগ্রেস এবং বিজেপির কোনো নেতা গত চল্লিশ বছরে টানা ২০ বছর দলীয় প্রধান ছিলেন এমন নজির নেই। পাকিস্তানের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)- তেও এমন নজির নেই।

মালদ্বীপের প্রধানমন্ত্রী ইব্রাহিম নাসির সিঙ্গাপুরে পালিয়ে গেলে ১৯৭৮ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত টানা ৩০ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন মামুন আব্দুল গাইয়ুম। পরবর্তী সময় ‘মালদ্বীপ প্রোগ্রেসিভ পার্টি’ গঠন করলেও ইতিহাসে তিনি একনায়ক হিসেবে পরিচিত। মামুন আব্দুল গাইয়ুম টানা ৩০ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন বটে, কিন্তু গণতান্ত্রিক ধারার রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন ২০১১ সালে। বর্তমানে তিনি দলীয় প্রধান হিসেবেই আছেন।

মালয়েশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি মাহাথির মোহাম্মদ টানা ২২ বছর ধরে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তবে দলীয় প্রধান হিসেবে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার থেকে তিনি অনেক পেছনে অবস্থান করছেন।

তবে শেখ হাসিনার এই পথচলা মসৃণ ছিল না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার সময় ছোট বোন শেখ রেহানা, স্বামী ও দুই সন্তানসহ পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। ১৯৮১ সালে ১৭ মে দেশে ফেরেন তিনি। সেই থেকে আজ অবধি আওয়ামী লীগের মতো একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব বয়ে চলছেন তিনি।

এই দায়িত্ব পালনকালে বার বার আক্রমণের শিকার হয়েছেন শেখ হাসিনা। সবশেষ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় এক জনসভায় বক্তৃতাদানকালে গ্রেনেড হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তিনি। রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে থেকে হত্যার সেই চেষ্টার পরেও শেখ হাসিনা তার সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে আছেন। আর শুধু বেঁচেই নেই, মৃত্যুর খড়গ সারাক্ষণ মাথার ওপর নিয়েই তিনি পরিচালনা করছেন ১৬ কোটি মানুষের একটি দেশ। যাদের একটা বড় অংশের এক সময়ে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের সংস্থান ছিল না, তাদের প্রত্যেকেরই এখন রয়েছে তার সবকিছু। দারিদ্র্যমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত একটি দেশ তিনি যেমন গড়ে তুলেছেন, তেমনি বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে আজ বাংলাদেশ। একসময় যাকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হতো, সেই বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত। বাংলাদেশের উন্নয়ন বিশ্বের কাছে বিস্ময় হয়ে উঠেছে। আর তা সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেকর্ড চতুর্থ মেয়াদ : বিশ্বের নারী নেত্রীদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি দিন সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের কাতারে শেখ হাসিনার অবস্থান মেয়াদের দিক দিয়ে তৃতীয়।

শ্রীলঙ্কার প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী সিরিমাভো বন্দরনায়েকে আধুনিক বিশ্বের প্রথম নারী সরকারপ্রধান ছিলেন। সিলন ও শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি তিন দফায় ১৭ বছর ২০৮ দিন দায়িত্ব পালন করেন।

দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী। ঘাতকের হাতে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত দুই দফায় মোট ১৬ বছর ১৫ দিন তিনি ভারত সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা তিন দফায় ১৫ বছর দায়িত্ব পালনের পর বর্তমানে চতুর্থ মেয়াদে আরও পাঁচ বছরের জন্য সরকারে আছেন। এই মেয়াদ পুরো হলে সবাইকে ছাড়িয়ে যাবেন তিনি।

ক্যারিবিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়া ডোমিনিকা প্রজাতন্ত্রের ইউজিনিয়া চার্লস ক্ষমতায় ছিলেন ১৪ বছর ৩২৮ দিন। ২০০৫ সাল থেকে একটানা ১৪ বছর জার্মানির ক্ষমতায় আছেন চ্যান্সেলর আঞ্জেলা মারকেল। ২০২১ সালে নির্বাচনের পর অবসরে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়ে রেখেছেন তিনি।

আফ্রিকার দেশ লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে একটানা ১২ বছর ৬ দিন দায়িত্ব পালনের পর এলেন জনসন সারলিফ ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা ছাড়েন। আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশ্বের নারী রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে এই ছয়জনই একযুগের বেশি সময় সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছেন।