আজ বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস, ইসলামে প্রতিবন্ধীদের অধিকার

আজ বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস, ইসলামে প্রতিবন্ধীদের অধিকার

ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ ।।

জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৯২ সাল থেকে প্রত্যেক বছরের ৩ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে ‘বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস’। প্রতিবন্ধীদের প্রতি সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও তাদের সমঅধিকারের ব্যাপারে গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পালিত হয় দিবসটি। উল্লেখ্য, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বর্তমান বিশ্বে প্রায় ১০ ভাগ এবং বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী।
প্রতিবন্ধী কারও নিজ ইচ্ছায় হয় না। বরং সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় জন্মগতভাবে অথবা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কারণে প্রতিবন্ধী হয়। এটি প্রকৃতির অনিবার্য বিষয়; এতে মানুষের কোনো হাত নেই। প্রকৃত রহস্য তাই আল্লাহই জানেন। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তিনিই মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি গঠন করেন। তিনি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা আলে ইমরান : ৬)। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, ‘আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্ব আল্লাহর। তিনি যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই। আর যাকে ইচ্ছা তাকে করে দেন বন্ধ্যা। তিনিই সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান।’ (সুরা শূরা : ৪৯-৫০)
কিন্তু সমাজের অনেকেই তা মেনে নিতে পারেন না। তাদের ব্যাপারে বিশেষ হীনম্মন্যতাও লক্ষ করা যায়। তা ছাড়া যারা প্রতিবন্ধী তাদের মধ্যেও হতাশা, নৈরাশ্যসহ নানাবিধ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। প্রতিবন্ধীদের মানসিক অবস্থা অস্বাভাবিক হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু সুস্থ-সবলদের থেকে অনাকাক্সিক্ষত আচরণ এবং প্রাপ্ত বঞ্চনাটুকু তাদের আরও কষ্টের সাগরে নিমজ্জিত করে। বিষিয়ে তোলে জীবন; এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত বেছে নেয় অনেকেই। যা মোটেও কাম্য নয়।
ইসলাম প্রতিবন্ধীদের শুধু সমঅধিকারের কথা বলেনি বরং বেশি অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে। কোরআনে বর্ণিত হয়েছেÑ ‘আর তাদের ধন-সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের অধিকার।’ (সুরা জারিয়াত : ১৯)। সে অধিকার শুধু দুনিয়াতে না; আখেরাতেও। দুনিয়ায় তাদের সব স্বাভাবিক সুবিধার পাশাপাশি আশপাশের নিকট ও দূরসম্পর্কের লোকজনের কাছ থেকে তারা পাবে বিশেষ ব্যবহার। এটি তাদের হক, যা ‘বান্দার হক’ হিসেবে বিবেচিত। এটি লঙ্ঘনকারীকে তাই শাস্তির কথা বলা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে তাদের দরকার সহযোগিতা। ইসলামের মূলনীতি হলো, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ দয়ালুদের ওপর দয়া ও অনুগ্রহ করেন। যারা পৃথিবীতে বসবাস করে তাদের ওপর তোমরা দয়া কর, তাহলে যিনি ঊর্ধ্বাকাশে আছেন তিনি তোমাদের ওপর দয়া করবেন। যে ব্যক্তি দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহও তার সঙ্গে দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করেন।’ (তিরমিজি : ১৯২৪)।
প্রতিবন্ধীদের যোগ্যতা অনুসারে যেকোনো চাকরি কিংবা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পদ পাওয়ার অধিকার রাসুলুল্লাহ (সা.) নিশ্চিত করেছেন। হাদিসে এসেছে, ‘রাসুল (সা.) অন্ধ সাহাবী ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)-কে দুইবার তার স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১৩০০)
ইসলামে প্রতিবন্ধিতা হলো পরীক্ষা। পরীক্ষা তার নিজের জন্য; তার নিকট আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী এমনকি সমাজের জন্যও। এ পরীক্ষায় ধৈর্য ধরলে প্রতিদান হিসেবে লাভ হবে চ‚ড়ান্ত সফলতাÑ জান্নাত। হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ বলেন, ‘আমি যার দুই প্রিয় জিনিস (চক্ষুদ্বয়) নিয়ে নিই, তার বিনিময়ে আমি তাকে জান্নাত দান করব।’ (বায়হাকি, শুয়াবুল ঈমান : ৫৩৬৭)
পৃথিবীতে অসংখ্য সফল মানুষ ছিলেন যারা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে বিশ্বের বুকে তাদের পদচিহ্ন এঁকে দিয়ে গেছেন; ইতিহাসে যাদের নাম লেখা থাকবে বহুদিন কিংবা অনন্তকাল। পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ১৯৮৫ সালে মটর নিউরন ডিজিজে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক বিকলাঙ্গ হয়েও বেঁচে ছিলেন কয়েক দশক। অথচ তার যে রোগ তাতে ডাক্তারদের ভাষ্যে খুব বেশি হলেও পাঁচ বছর বাঁচার কথা ছিল। কিন্তু তিনি মারা গেলেন গত ১৪ মার্চ ২০১৮। হাদিস শাস্ত্রের সবচেয়ে বিশুদ্ধ গ্রন্থ হলো সহিহ বুখারি। এ গ্রন্থ যতদিন মানুষ অধ্যায়ন করবে ততদিন মনে রাখবে হাদিস বিশারদ ইমাম আমাশের (রহ.) কথা। অথচ তিনি ছিলেন অন্ধ। ২০ বছর বয়সে দুই চক্ষু হারিয়ে অন্ধ হয়ে যাওয়া শায়খ আব্দুল আজিজ বিন বাজ (রহ.) বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের শেষ দিকে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৯ সালে মৃত্যু পর্যন্ত সৌদি গ্রান্ড মুফতির পদটি অলঙ্কৃত করেছিলেন তার নিজ যোগ্যতায়। অন্ধত্ব তাকে থামিয়ে দেয়নি। এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে আমাদের মাঝে। তাই প্রতিবন্ধীদের প্রতি অবহেলা না করে সহমর্মিতার হাত বাড়ানোটা আমাদের দায়িত্ব শুধু নয় বরং তাদের ক্ষমতায়ন করার প্রয়াসও। সুতরাং ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ, সংগঠন, রাষ্ট্র এমনকি বিশ্ব কর্তাব্যক্তিদের নিশ্চিত করতে হবে প্রতিবন্ধীদের অধিকার। আর এসবে অন্য পদক্ষেপের পাশাপাশি ধর্ম বিশেষ করে ইসলামের শিক্ষার বাস্তবায়ন কার্যকরী হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। বিশ্বের সব প্রতিবন্ধীরা ভালো থাকুক এই প্রত্যাশা।