আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস

আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস
আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস

জাকির হোসেন, সময়ের আলো ।।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আজ। ১৯৭২ সালের এদিন দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে প্রথমে লন্ডন যান। তারপর দিল্লি হয়ে ঢাকা ফেরেন।

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বৈশি^ক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে আওয়ামী লীগ। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছেÑ রোববার সকাল সাড়ে ৬টায় দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও সারা দেশে সংগঠনের সব কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ৯টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন। বেলা সাড়ে ৩টায় ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সীমিত পরিসরে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভা। আলোচনা সভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য রাখবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দিবসটি  যথাযথ মর্যাদায় পালনের জন্য বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে আওয়ামী লীগ এবং সংগঠনের সব সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন কেন্দ্রীয় কমিটির অনুরূপ কর্মসূচির আয়োজন করেছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের সব কর্মসূচি স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি মেনে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালনের জন্য দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীসহ সংগঠনের সব সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পর পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে তাঁকে গ্রেফতার করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে আটক রাখা হয়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে নয় মাস যুদ্ধের পর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলেও ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে জাতি বিজয়ের পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করে। জাতির পিতা পাকিস্তান থেকে ছাড়া পান ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি ভোর রাতে ইংরেজি হিসাবে ৮ জানুয়ারি। এদিন বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হোসেনকে বিমানে তুলে দেওয়া হয়। সকাল সাড়ে ৬টায় তারা পৌঁছান লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে। সকাল ১০টার পর থেকে তিনি কথা বলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, তাজউদ্দিন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকের সঙ্গে। পরে ব্রিটেনের রাজকীয় বিমানবাহিনীর একটি বিমানে করে পরের দিন ৯ জানুয়ারি দেশের পথে যাত্রা করেন।

দশ তারিখ সকালে তিনি নামেন দিল্লিতে। সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সমগ্র মন্ত্রিসভা, প্রধান নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধান এবং অন্যান্য অতিথি ও সে দেশের জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা লাভ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু ভারতের নেতৃবৃন্দ এবং জনগণের কাছে তাদের অকৃপণ সাহায্যের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান। তাঁর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা হিসেবে।’

বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি দুপুরে ঢাকা পৌঁছেন। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পর বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানোর জন্য প্রাণবন্ত অপেক্ষায় ছিল। আনন্দে আত্মহারা লাখ লাখ মানুষ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত তাঁকে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানায়। বিকাল ৫টায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তিনি ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধু দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বাংলার একজন লোকও বেঁচে থাকতে এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেব না। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে এমন কোনো শক্তি নেই।’ দেশবাসীর সামনে বক্তৃতা করতে গিয়ে তার চোখে অশ্রু নেমে আসে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। পশ্চিম পাকিস্তানে আমি ফাঁসিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে। খেয়ে-পরে সুখে থাকবে এটাই ছিল আমার সাধনা। গত ৭ মার্চ এই রেসকোর্সে বলেছিলাম দুর্গ গড়ে তোল। আজ আবার বলছি, আপনারা সবাই একতা বজায় রাখুন। একজন বাঙালি বেঁচে থাকতেও এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেব না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন দেশ রূপেই বেঁচে থাকবে। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে এমন কোনো শক্তি নাই।’

বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশ হবে একটি আদর্শ রাষ্ট্র। কোনো বিশেষ ধর্ম রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, নেতা হিসেবে নয়, আপনাদের ভাই হিসেবে বলছিÑ ‘যদি দেশবাসী খাবার না পায়, বস্ত্র না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায় তা হলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবেÑ পূর্ণ হবে না।’

দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন ও সহযোগিতা করার জন্য বঙ্গবন্ধু ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স ও মার্কিন জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, বাংলার এক কোটি লোক প্রাণভয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের খাবার ও বাসস্থান দিয়ে সহযোগিতা করেছে ভারত। সে জন্য ভারতীয় সরকার, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের জনগণকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে মোবারকবাদ।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ইন্দিরা গান্ধী পণ্ডিত জওহর লাল নেহরুর কন্যা, পণ্ডিত মতিলাল নেহরুর নাতনি। তার রক্তে মিশে রয়েছে রাজনীতি। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ব্যক্তিগতভাবে বিশে^র সব রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আমার মুক্তির জন্য আবেদন করেছেন। এ জন্য আমি শ্রীমতী গান্ধী ও ভারতীয় জনগণের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমার সঙ্গে দিল্লিতে শ্রীমতী গান্ধীর আলাপ হয়েছে। আমি যখনই বলব তখনই ভারতীয় সেনাবাহিনী ফেরত যাবে। এখনই আস্তে আস্তে অনেককে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু বলেন, ২৫ মার্চের সেই রাতে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার সময় আমার সহকর্মী তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও অন্যরা কাঁদছিলেন। কিন্তু আমি বলেছি, এখানে আমি মরতে চাই। তবু মাথা নত করতে পারব না। ইয়াহিয়া খান আমার ফাঁসির হুকুম দিয়েছিল। আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। বাঙালিরা একবারই মরতে জানে। তাই বলেছি ক্ষমা চাই না। তাদের বলেছি, তোমরা মারলে ক্ষতি নেই। কিন্তু আমার লাশটা বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও।