অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য দুদকের তদন্তে , ফেঁসে যাচ্ছে এক ডজন পুলিশ কর্মকর্তা

ইসফাক মু. আবির ।।

অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য দুদকের তদন্তে , ফেঁসে যাচ্ছে এক ডজন পুলিশ কর্মকর্তা
অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য দুদকের তদন্তে , ফেঁসে যাচ্ছেন এক ডজন পুলিশ কর্মকর্তা

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে ফেঁসে যাচ্ছেন চট্টগ্রামের এক ডজন পুলিশ কর্মকর্তা।

এরই মধ্যে দুদক কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এক পুলিশ কর্মকর্তার সম্পদ ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বেশ কয়েক জনের বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনুসন্ধানে মিলেছে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য। এসব পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে রয়েছেন- চট্টগ্রাম জেলা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের সহকারী পরিচালক (এএসপি) আবুল হাশেম, চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার সাবেক ওসি মো. রেফায়েত উল্লাহ, লোহাগাড়া থানার সাবেক ওসি মো. শাহাজাহান, সিএমপির পাঁচলাইশ থানার ওসি আবুল কাশেম ভূঁইয়া, সিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার এবিএম এবিএম সাহাদাৎ হোসেন মজুমদার, সিএমপির ট্রাফিক বিভাগের সাবেক (বন্দর-টিআই প্রশাসন) আবুল কাশেম চৌধুরী, টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বন্দর থানার সাবেক ওসি এস এম ময়নুল ইসলাম, কর্ণফুলী থানার ওসি আলমগীর মাহমুদ ও বোয়ালখালী থানার সাবেক ওসি মোহাম্মদ শামসুল ইসলাম।
আবুল হাশেম : চট্টগ্রাম জেলা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের সহকারী পরিচালক (এএসপি) আবুল হাশেম। ২০১৭ সালে দুদকের হটলাইনে (১০৬) আসা এক ফোনকলের সূত্র ধরে এএসপি আবুল হাশেমের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে দুদক। দুদক সূত্র জানায়, পুলিশ কর্মকর্তা আবুল হাশেম ২০১০-২০১১ থেকে ২০১৭-২০১৮ করবর্ষে আয়কর নথিপত্রে বৈধ আয় দেখান ৬৭ লাখ ৬৫ হাজার ১৭৩ টাকা। কর পরিশোধসহ তার পারিবারিক ব্যয় ১৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে মোট আয় থেকে খরচ বাদ দিলে দাঁড়ায় ৫৩ লাখ ৯০ হাজার ১৭৩ টাকা। এদিকে দুদকের অনুসন্ধানে তাঁর বিরুদ্ধে মোট স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের অর্জনের খোঁজ পাওয়া যায় এক কোটি দুই লাখ ৩৭ হাজার ৪১৩ টাকার। এখানে মোট আয়ের পরিমান বাদ দিলে ৪৮ লাখ ৪৭ হাজার ২৮৫ টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়।
এছাড়া আবুল হাশেমের স্ত্রী তাহেরিনা বেগমের এক কোটি এক লাখ ৬ হাজার ৭৯৬ টাকা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের খোঁজ পায় দুদক। ওই টাকা থেকে মোট আয়ের পরিমান বাদ দিয়ে ১৯ লাখ ৫১ হাজার ৫৪৪ টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রাথমিকভাবে সত্যতা পায় দুদক।
সাহাদাৎ হোসেন মজুমদার : ১৯৮৫ সালে এবিএম সাহাদাৎ হোসেন মজুমদার বাংলাদেশ পুলিশে সার্জেন্ট পদে যোগদান করেন। ২০০৬ সালের ১৬ এপ্রিল তিনি ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি পান। বর্তমানে তিনি সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে সিএমপির মনসুরাবাদ ডাম্পিংএ কর্মরত। সাহাদাত হোসেন ফেনী জেলার ফুলগাজী থানার আমজাদহাট এলাকার মোশারফ হোসেন মজুমদারের ছেলে। থাকেন নগরীর পাহাড়তলী থানাধীন দক্ষিণ কাট্টলীর চুনা ফ্যাক্টরি মোড় এলাকায়।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সাহাদাৎ হোসেন নিজ ও স্ত্রী-সন্তানদের নামে ২ কোটি ২১ লাখ ১৩ হাজার ৯০০ টাকার স্থাবর সম্পদ ও ৪৪ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকার অস্থাবর সম্পদ পাওয়া যায়। এরমধ্যে তার গ্রহণযোগ্য আয় ১ কোটি ৭৭ লাখ ৫৩ হাজার ২৩৭ টাকা। বাকী ১ কোটি ২ লাখ ১০ হাজার ৭১৬ টাকার আয়ের উৎস দুদককে দেখাতে পারেননি এ পুলিশ কর্মকর্তা। এছাড়া তার দ্বিতীয় ছেলে মো. আকিব জাভেদ মজুমদার লেখাপড়া করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ ছেলের লেখাপড়ার ব্যয়ভার সম্পর্কে তিনি দুদক কর্মকর্তাদের স্পষ্ট কোনো জবাব দিতে পারেননি। এ ছাড়া সাহাদাৎ হোসেন মজুমদার তার স্ত্রী ও সন্তানদের নামে কোনো সম্পদ আছে কিনা তার কোনো তথ্য দুদককে সরবরাহ করেননি বলেও জানিয়েছেন দুদক চট্টগ্রাম-১ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক নুরুল ইসলাম।
মো. রেফায়েত উল¬াহ চৌধুরী : চট্টগ্রামের পটিয়া থানার সাবেক ওসি মো. রেফায়েত উল¬াহ চৌধুরী স্ত্রীর করা নির্যাতন মামলায় সাময়িক বরখাস্ত হয়ে বর্তমানে রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত আছেন। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. হুমায়ুন কবীর জানান, প্রাথমিক অনুসন্ধানে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ মিলেছে রেফায়েত উল¬াহর বিরুদ্ধে। তিনি ২০১৭ সালের ২৬ জানুয়ারি ছয়টি চেকের মাধ্যমে এবি ব্যাংক চট্টগ্রামের সিডিএ অ্যাভিনিউ শাখার মাধ্যমে মো. ইলিয়াছ নামের এক ব্যক্তিকে ফ্ল্যাট কেনা বাবদ ৪১ লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করেন। ওই বছরের ১৩ মার্চ নগরীর চান্দগাঁও এলাকায় এক হাজার ৪৫০ বর্গফুটের ওই ফ্ল্যাট নিবন্ধন করেন তার ভাই আফতাব উল্লাহ চৌধুরীর নামে। পরের বছরের ২২ জুলাই আফতাব তাদের আরেক ভাই হাফিজ উল¬াহ চৌধুরীর নামে হেবা দান করে দেন এই ফ্ল্যাট। এছাড়া ২০১৭ সালের মার্চ মাসে দুটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ৬৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ভাই আফতাব উল¬াহর নামে দেন রেফায়েত উল্ল¬াহ।
দুদকের এই কর্মকর্তা আরও জানান, অবৈধভাবে আয় করা সম্পদ গোপন করতেই মূলত ভাইদের নামে ফ্ল্যাট কেনেন ওসি রেফায়েত। দুদকের অনুসন্ধানে তা বের হয়ে এসেছে। এ কারণে তার ফ্ল্যাটটি ক্রোক করার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করা হলে আদালত ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদনের জন্য ঢাকা সদরদফতরে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন এলে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে।
মো. শাহজাহান : চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া ও সন্দ্বীপ থানার সাবেক ওসি মো. শাহজাহান বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলা ট্যুরিস্ট পুলিশে কর্মরত। তিনি কুমিল্ল¬া জেলার লালমাই থানার হাজাতখোলা বাজার কাতালিয়া গ্রামের সুলতান আহমদের ছেলে। পরিবারসহ চট্টগ্রামের খুলশী থানার দামপাড়া ১৪ হাইলেভেল  রোড লালখানবাজার এলাকায় বসবাস তার।
দুদক সূত্র জানায়, ১৯৯০ সালে চাকরি শুরুর পর থেকে মো. শাহজাহানের নামে সর্বমোট ২ কোটি ৬৪ লাখ ২৭ হাজার ৭০০ টাকা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৮৬ লাখ ৬৩ হাজার ৩৮৭ টাকা ঋণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। চাকরি নেওয়ার পর থেকে তার বৈধভাবে আয় ৭৮ লাখ ৫২ হাজার ৯৭৬ টাকা। পারিবারিক ও অন্যান্য খাতে তিনি ব্যয় করেছেন ২৬ লাখ টাকা ১২ হাজার ৪৭৩ টাকা। সবমিলিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে জ্ঞাত আয়বর্হিভূত সম্পদের পরিমাণ মিলেছে ১ কোটি ২৫ লাখ ২৩ হাজার ৮১০ টাকা।
এছাড়া তার স্ত্রী ফেরদৌসী আক্তারের নামে সর্বমোট স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৩ কোটি ১৭ লাখ ৭৫ হাজার ৬১৭ টাকা। এর মধ্যে বৈধ আয় ৪৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬৫৫ টাকা। পারিবারিক ও অন্যান্য খাতে তিনি ব্যয় করেছেন ১৩ লাখ ২৮ হাজার ৭৩০ টাকা। সবমিলিয়ে তার বিরুদ্ধে ২ কোটি ৮৩ লাখ ২ হাজার ৬৯২ টাকা জ্ঞাত আয়বর্হিভূত সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুদক।
দুদক চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মো. হুমায়ুন কবীর জানান, ওসি মো. শাহজাহান ও তার স্ত্রী ফেরদৌসী আক্তারের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে ৪ কোটি ৮২ লাখ ৬ হাজার ৫০২ টাকা জ্ঞাতবর্হিভূত সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে নামে বেনামে আরো অস্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ থাকতে পারে বলে মনে হচ্ছে। এসব বিষয়ে তদন্ত শেষে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
টিআই আবুল কাশেম চৌধুরী : চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের বন্দর জোনের সাবেক টিআই-প্রশাসন আবুল কাশেম। দীর্ঘ এক বছর ধরে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুদক। ফেনী জেলার পরশুরাম থানার বাঘমারা গ্রামের মৃত মোখলেছুর রহমান চৌধুরীর ছেলে আবুল কাশেম। ১৯৮৫ সালে আবুল কাশেম চৌধরী পুলিশে সার্জেন্ট পদে যোগদান করেন। টিআই আবুল কাশেম ও তার স্ত্রী ফাতিমা বেগমের বিরুদ্ধে ৫৫ লাখ ২২ হাজার ৪৬৩ টাকাসহ আবুল কাশেমের নামে-বেনামে স্থাবর সম্পত্তি থাকার খোঁজ পেয়েছে দুদক।
এ প্রসঙ্গে দুদক চট্টগ্রাম-১ কার্যালয়ের উপ পরিচালক লুৎফর কবীর চন্দন জানান, টিআই আবুল কাশেম ও তার স্ত্রী ফাতিমা বেগমের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য মিলেছে। আরও যেসব পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে তাদের বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রদীপ কুমার দাশ : টেকনাফ মডেল থানার ওসি হিসেবে রয়েছেন প্রদীপ কুমার দাশ। তিনি নগরীর পাঁচলাইশ, বায়েজিদ বোস্তামী থানায় ওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৫ সালে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি থাকাকালীন সুপার রিফাইনারি লিমিটেডের চেয়ারম্যান শিল্পপতি সেলিম আহাম্মদের বিরুদ্ধে তেল পাচারের মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি টেকনাফ মডেল থানার ওসি হিসেবে কর্মরত। বর্তমানে তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে দুদক।
আবুল কাশেম ভুঁইয়া : ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ত্রিশ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে পাঁচলাইশ থানার ওসি আবুল কাশেম ভূঁইয়াসহ ৬ পুলিশ সদস্য ও তিন সোর্সের বিরুদ্ধে মামলা করেন নগরীর পতেঙ্গা এলাকার বাসিন্দা নুরুল আবছার। মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছেন দুদক। চলতি বছরের ২৫ মার্চ আদালতে দায়ের করা মামলায় বাকী আসামিরা হলো- পতেঙ্গা থানার এসআই প্রণয় প্রকাশ, আবদুল মোমিন, এএসআই তরুণ কান্তি শর্মা, কামরুজ্জামান ও মিহির কান্তি। এছাড়া ইলিয়াছ, জসিম ও নুরুল হুদা নামে আরও তিন সোর্সকে এ মামলায় আসামি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে নুরুল আবছার দাবি করেন, ২০১৮ সালের ১ জুন বিকেলে নগরীর পতেঙ্গা কাটগড় এলাকা থেকে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা তাকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ৩০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। পরদিন তাকে ইয়াবা ব্যবসায়ী অপবাদ দিয়ে আটক রাখা হয়। একপর্যায়ে ওই ব্যক্তি ১৫ লাখ টাকা পুলিশের হাতে তুলে দেন। অবশিষ্ট ১৫ লাখ টাকা না দেয়ায় তাকে বিদেশি মদ উদ্ধারের একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে চালান দেয়া হয়েছিল। পরে জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে নুরুল আবছার পাঁচলাইশ ওসিসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন।
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপসহকারী পরিচালক নুরুল ইসলাম জানান, মামলাটি এখনও তদন্তাধীন। এ ঘটনায় বাদির কাছে যেসব তথ্য প্রমাণ আছে তা সংগ্রহ করা হয়েছে।