প্রভাবশালী আমলারা দুদকের জালে , সরকারি দফতরগুলোতে বেড়েছে নজরদারি

রফিকুল ইসলাম সবুজ , সময়ের আলো ।।

প্রভাবশালী আমলারা দুদকের জালে , সরকারি দফতরগুলোতে বেড়েছে নজরদারি

দুর্নীতি দমন কমিশনের জালে রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি এবার প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। এ উদ্দেশ্যে দুর্নীতিপ্রবণ ও দুর্নীতির বিষয়ে জনশ্রুতি রয়েছে এমন ২৮টি সরকারি দফতরে নজরদারি বাড়িয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির গোয়েন্দা শাখা এসব দফতরে তৎপরতা চালাচ্ছে। দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত লোকজনের খোঁজখবর রাখার পাশাপাশি তাদের গতিবিধিও নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।

সম্প্রতি শুদ্ধি অভিযান শুরু হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে দুদকও। গত দু’মাসে অন্তত ২৫ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেফতার করেছে প্রতিষ্ঠানটি। দুদক সূত্র বলছে, এই অভিযান অব্যাহত থাকবে। উচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিবিদ-আমলাসহ অনেকের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

দুদকের তথ্য মতে, সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতির যেসব অভিযোগ এসেছে, তার অর্ধেকের বেশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পাসপোর্ট, ভূমি প্রশাসন, আর্থিক খাত, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যাংক, ওয়াসা, কাস্টমস, এলজিইডি, গণপূর্ত অধিদফতর, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস এবং সড়ক ও জনপথ অধিদফতরসহ বিভিন্ন সরকারি দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশি জমা পড়ছে দুদকে। দুদক কর্মকর্তারা জানান, এসব দফতরে দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখা হচ্ছে, যাতে তারা ঘুষ খাওয়ার সুযোগ ও সাহস না পান।

২০১৭ সালের ১৮ জানুয়ারি গুরুত্বপূর্ণ ১৫টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনে দুদক ১৪টি প্রাতিষ্ঠানিক দল গঠন করে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট, আয়কর বিভাগ, গণপূর্ত অধিদফতর, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি), মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ঢাকা ওয়াসা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, বাংলাদেশ রেলওয়ে, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি এবং ঢাকা মহানগরের সব সাব-রেজিস্ট্রি অফিস।

পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, দেশের সব স্থলবন্দর, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর, ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও পরিবেশ অধিদফতরের দুর্নীতি অনুসন্ধানে আরও পাঁচটি দল গঠন করে দুদক। দলগুলোকে কিছু সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান আইন, বিধি, পরিচালনাপদ্ধতি, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ-অপচয়ের দিক পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা। গত দেড় বছরে দুদকের এসব দল ১৫টি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির উৎস ও তা বন্ধে কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ তুলে ধরে কমিশনের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। পরে সেই প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও সরকারের নীতিনির্ধারণী বিভাগগুলোতে পাঠানো হয়। এসব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার মধ্যে রয়েছে গণপূর্ত অধিদফতর, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিআরটিএ, রাজউক, তিতাস গ্যাস, আয়কর বিভাগ, কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়, ঢাকা ওয়াসা, বিমান ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ।

দুদক সূত্র জানায়, এসব প্রতিষ্ঠানের প্রভাবশলী দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ফাঁদ পেতে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়। গত তিন বছরে ফাঁদ পেতে অর্ধশত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেফতার করেছে দুদক। দুদকের ফাঁদে পড়েছেন প্রকৌশলী, সাব-রেজিস্ট্রার, ভূমি কর্মকর্তা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তা, খাদ্য কর্মকর্তা, কাস্টমস কর্মকর্তা, রাজস্ব কর্মকর্তা, শিক্ষা কর্মকর্তা, আদালতের বেঞ্চ সহকারী, ওয়াসা কর্মকর্তাসহ অনেকে। এর মধ্যে অন্যতম নৌপরিবহন অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী একেএম ফখরুল ইসলামকে ঘুষের পাঁচ লাখ টাকাসহ নিজ দফতর থেকে দুদকের একটি দল গ্রেফতার করে ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই।

পরের বছর এপ্রিলে একই দফতরের প্রধান প্রকৌশলী এসএম নাজমুল হককে ঘুষের পাঁচ লাখ টাকাসহ রাজধানীর সেগুনবাগিচার একটি হোটেল থেকে গ্রেফতার করা হয় ফাঁদ পেতে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে আনসার কমান্ড্যান্ট আশিকুর রহমানকে এক লাখ টাকাসহ গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া গত ২ সেপ্টেম্বর নৌপরিবহন অধিদফতরের শিপ সার্ভেয়ার মির্জা সাইফুর রহমানকে ঘুষের দুই লাখ টাকাসহ আটক করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত চার বছরে দুর্নীতি দমন কমিশনের অভিযানে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের বড় অংশই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী।

দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য ভুক্তভোগীরা যাতে সরাসরি জানাতে পারেন, সেজন্য ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই দুদকের হটলাইন ‘১০৬’ চালু হয়। বিনাখরচে এবং যেকোনো মোবাইল বা টেলিফোন থেকে এই নম্বরে ফোন করে দুদককে দুর্নীতির তথ্য, অভিযোগ জানানো যায়। দুদক সূত্র বলছে, গত দুবছরে এই নম্বরে প্রায় ২৫ লাখ অভিযোগ এসেছে। এর বাইরে লিখিত অভিযোগ এসেছে প্রচুর। দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ জানান, এসব অভিযোগের মধ্যে একটি বড় অংশ দুদকের তফসিলভুক্ত না হওয়ায় সেগুলো আমলে নিতে পারেনি তারা।

তফসিলভুক্ত অপরাধগুলোর মধ্যে যেগুলো গুরুতর, সেগুলো অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, অধিকাংশ অভিযোগ কমিশন আইনের তফসিলভুক্ত না হলেও মানুষ তাদের অভিযোগ জানানোর একটি প্ল্যাটফর্ম পেয়েছে। তারা তাদের কথা জানাতে পারছে। কমিশন থেকেও যতটা সম্ভব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা হয়তো আজই সবাইকে ধরতে পারব না। তবে প্রতিকারমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে সবার কাছে একটি বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছি যে, আজ হোক কাল হোক, সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে। সব সেক্টরেই কাউকে না কাউকে আইনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, নির্বাচনি ইশতেহারে দুর্নীতিমুক্ত জনপ্রশাসন গড়ে তোলার অঙ্গীকার ছিল। নির্বাচনি ইশতেহার অনুযায়ী দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান এখন দৃশ্যমান হয়েছে। এতে জনগণের ইতিবাচক সাড়াও মিলছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির শাস্তি হিসেবে অনেকের পদোন্নতি আটকে রাখা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের প্রত্যেকের সম্পদের হিসাব নেওয়ার কাজ চলছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন প্রতিবছর আয়কর রিটার্ন জমা দেন। এক্ষেত্রে কেউ সম্পদের হিসাব গোপন করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।