অপ্রতুল পরীক্ষা চট্টগ্রামে রোগী শনাক্তে বড় বাধা, রিপোর্ট পেতেও বিলম্ব

অপ্রতুল পরীক্ষা চট্টগ্রামে রোগী শনাক্তে বড় বাধা, রিপোর্ট পেতেও বিলম্ব

রতন বড়ুয়া।।

প্রাণঘাতী করোনা শনাক্তের পরীক্ষা শুরুর পর বুধবারের আগের ২৪ ঘন্টাতেই সর্বোচ্চ সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা হয়েছে দেশে। আর বেশি সংখ্যক নমুনা পরীক্ষার ফলে ওই ২৪ ঘন্টায় রোগীও শনাক্ত হয়েছে সর্বোচ্চ সংখ্যক। বুধবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ের আগের ২৪ ঘন্টায় ৪ হাজার ৯৬৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। যা ২৪ ঘন্টার হিসেবে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ। এই সময়ে নতুন করে ৬৪১ জনের করোনা শনাক্ত হয়। শনাক্তের এই সংখ্যাও একদিনে সবচেয়ে বেশি। এ নিয়ে দেশে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৭ হাজার ছাড়াল।

বিশেষজ্ঞরাও বলছেন- সর্বোচ্চ সংখ্যক নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা এখন সবচেয়ে জরুরি। কারণ, একমাত্র নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমেই করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা সম্ভব। শনাক্ত করা গেলে আক্রান্ত রোগীকে দ্রুত আলাদা করা যায়। এতে ওই রোগীর মাধ্যমে নতুন করে সংক্রমণের সুযোগ কমে আসে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে তাই বেশি বেশি নমুনা পরীক্ষাতেই গুরুত্ব দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও।

সংস্থাটির মহাপরিচালক বলেছিলেন- টেস্ট, টেস্ট এণ্ড টেস্ট। পরে দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও বেশি বেশি নমুনা পরীক্ষার জন্য গণমাধ্যমে দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান। তবে দেশে এখনো পর্যন্ত পর্যাপ্ত সংখ্যক নমুনা পরীক্ষার সুযোগ গড়ে উঠেনি। সারাদেশে এখনো পর্যন্ত দৈনিক নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা ৫ হাজারের কাছাকাছি। যদিও সিংহভাগ পরীক্ষাই হচ্ছে ঢাকায়। চট্টগ্রামে নমুনা পরীক্ষার চিত্র খুবই ভঙ্গুর বলা চলে। গত ২৫ মার্চ থেকে ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডিতে নমুনা পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। একমাস পর (২৫ এপ্রিল) থেকে শুরু হয়েছে ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়েও। এই দুটি ল্যাবে দৈনিক দুইশো’র কিছু বেশি নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে চট্টগ্রামে। তবে পরীক্ষার জন্য সংগৃহীত নমুনার জট লেগে আছে বিআইটিআইডির ল্যাবে। গতকাল পর্যন্ত হাজারেরও বেশি নমুনার জট লেগে গেছে বলে বিআইটিআইডির ল্যাব সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে।

চট্টগ্রাম ছাড়াও আরো পাঁচটি জেলার ( নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষীপুর, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি) নমুনা আসছে চট্টগ্রামে। সব মিলিয়ে দৈনিক আড়াইশোর বেশি নমুনা আসছে বলে জানিয়েছেন বিআইটিআইডি ল্যাব ইনচার্জ ডা. শাকিল আহমেদ। কিন্তু দুটি ল্যাবে সবমিলিয়ে দুইশো বা এর কিছু বেশি নমুনা পরীক্ষা করা যাচ্ছে। সে হিসেবে দিন দিন নমুনা জট বাড়ছে বলেও জানান তিনি। এদিকে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) ল্যাবটিও চালুর অপেক্ষায় রয়েছে। তবে চালু হলে চমেকের ল্যাবেও দৈনিক একশোর বেশি নমুনা পরীক্ষার সুযোগ থাকছে না। সে হিসেবে তিনটি ল্যাবে পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু হলেও সবমিলিয়ে দিনে সাড়ে তিনশোর বেশি নমুনা পরীক্ষার সুযোগ থাকছে না চট্টগ্রামে। প্রায় ৭০ লাখ বাসিন্দার শহরে যা খুবই অপ্রতুল বলে মনে করেন চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য, চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা ও অন্যান্য জেলা মিলিয়ে জনসংখ্যা আরো কয়েকগুণ বেশি।

রিপোর্ট পেতে বিলম্ব : ২৫ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রাম মহানগরে ২ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। এর মধ্যে একজন হালিশহর নয়াবাজার চুনা ফ্যাক্টরি এলাকার বাসিন্দা। ৪০ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। সীতাকুন্ডে তাঁর কর্মস্থল। শরীরে জ্বর দেখা দিলে গত ২০ এপ্রিল চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে নমুনা দেন তিনি। তবে নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট আসে ২৫ এপ্রিল (শনিবার) রাতে। রিপোর্টে তার করোনা পজিটিভ আসে।

অপরজন নগরীর আগ্রাবাদ হাউজিং সোসাইটি শান্তিবাগ এলাকার বাসিন্দা। ৩০ বছর বয়সী ওই যুবক একজন ব্যবসায়ী। ৮/১০ দিন আগে হালকা গলাব্যাথা দেখা দিলেও জ্বর বা সর্দি-কাশি তেমন ছিল না। এরপরও জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে ১৯ এপ্রিল তিনি নমুনা দিয়ে আসেন। তাঁর রিপোর্টও আসে ২৫ এপ্রিল। রিপোর্টে তার শরীরেও করোনা শনাক্ত হয়। কিন্তু নমুনা দিয়ে তাঁরা দুজনই বাসায় ফিরে যান। আর স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের সকল সদস্যদের নিয়ে তাঁরা একইসাথে ছিলেন। আলাদা ছিলেন না। নমুনা দেয়ার পর রিপোর্ট পেতে মাঝখানে ৬/৭ দিন সময় লাগছে। এই সময়টাতে সংক্রমণের ভয়াবহ ঝুঁকির কথা বলছেন জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির আহবায়ক মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান ও সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া। বিশেষ করে এসময়ে ব্যাপক হারে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ছে বলেও মনে করেন তাঁরা।

রিপোর্ট পেতে দেরির বিষয়ে বিআইটিআইডির ল্যাব ইনচার্জ ডা. শাকিল আহমেদ বলেন, নমুনার জট পড়ে আছে। যার কারণে ৬/৭ দিন আগে সংগ্রহ করা নমুনা গুলো এখন পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ জন্য রিপোর্ট পেতে সময় লাগছে। ডা. শাকিল আহমেদ বলেন, কয়েকদিন আমরা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে পেরেছিলাম। কিন্তু রোজায় সেটি কমে গেছে। ভলান্টিয়ারদের এখন নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া সবাই রোজা রাখছে। সবমিলিয়ে পরীক্ষার গতিটা কমে গেছে। পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে হলে অবশ্যই সক্ষমতা বাড়াতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে, ভেটেরিনারিতে নমুনা পরীক্ষার উপযোগী চারটি পিসিআর মেশিন থাকলেও মাত্র একটি মেশিনে পরীক্ষা কার্যক্রম চলছে ল্যাবটিতে। যদিও পর্যাপ্ত টেকনোলজিস্ট ও কিছু সুরক্ষা সরঞ্জাম পেলে বাকি মেশিনগুলোতেও পরীক্ষা কার্যক্রম চালানো যাবে বলে জানিয়েছেন ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর গৌতম বুদ্ধ দাশ। তবে টেকনোলজিস্ট কার কাছে চাইবেন, সে বিষয়ে দ্বিধায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

৬/৭ দিনের আগে রিপোর্ট না পাওয়ার বিষয়ে ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, নমুনা দেয়ার পর ৬/৭দিন পর জানতে পারছেন তাঁরা করোনায় আক্রান্ত। অথচ এই সময়টাতে তারা কেউ আলাদা থাকছেন না। পরিবারের সকলের সাথে মিলেমিশে থাকছেন। পারলে বাইরেও বের হচ্ছেন। এতে করে পরিবারের সদস্যরা তো আছেই, অন্যান্য যারা তার সংস্পর্শে গিয়েছিলেন, তারাও ওই ব্যক্তির মাধ্যমে আক্রান্ত হতে পারেন। অনেকটা নিজেদের অজান্তেই অন্যের সংক্রমণের কারণ হচ্ছেন তারা। কিন্তু নমুনা দেয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা অথবা হাসপাতালে আলাদা রাখার ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। এছাড়া নমুনা দেয়ার পর অন্তত ২/১ দিনের মধ্যেই রিপোর্ট পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

৫০ ভাগ না হলেও অন্তত এক-তৃতীয়াংশ মানুষের নুমনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার উল্লেখ করে এই প্রবীণ চিকিৎসক বলেন, এর জন্য ল্যাবের সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে ল্যাবের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। মোটকথা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে যা যা করণীয় সরকারকে সবই করতে হবে। আর সরকারের অঙ্গ হিসেবে স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য প্রশাসনকে এ উদ্যোগ নিতে হবে। তাছাড়া করোনা মোকাবেলায় জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটিও পদক্ষেপ নিতে পারে। একমত পোষণ করে ডা. সুশান্ত বড়ুয়া বলেন, রোগী শনাক্তকরণে নমুনা পরীক্ষাই সবচেয়ে কার্যকর উপায়। তাই পরীক্ষা যত কম হবে রোগীও কম শনাক্ত হবে। আর রোগী শনাক্ত করে আলাদা করতে না পারলে নতুন করে সংক্রমণ ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়বেই। তাই পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই।

নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে করোনা মোকাবেলায় জেলা পর্যায়ের কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রামের জেলাপ্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সার্বিক বিষয় মনিটরিং করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক স্বয়ং এসব বিষয় ডিল করছেন। ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক মেশিন থাকার বিষয়টিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অবগত আছে। তাই সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত আসতে হবে। সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বিও বলছেন- এসব বিষয়ে ঢাকা থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, গতকাল (২৯ এপ্রিল) পর্যন্ত আড়াই হাজারের কিছু বেশি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে চট্টগ্রামে। এর মধ্যে শুধু চট্টগ্রাম জেলায় ৬৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। তবে ঢাকা ও রাজবাড়ি থেকে আসা করোনা পজিটিভ তিনজন চট্টগ্রামের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭২ জনে। করোনা আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৬ জন।