অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা টিকা আমদানির অনুমোদন, ভ্যাকসিনে বাধা নেই

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা টিকা আমদানির অনুমোদন, ভ্যাকসিনে বাধা নেই

পোস্টকার্ড ডেস্ক।।

বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা টিকা আমদানির অনুমতি দিয়েছে । 

সোমবার (৪ জানুয়ারি) রাতে বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান। এ দিন ভ্যাকসিন আমদানিতে বেক্সিমকোকে অপানপত্তিপত্র (এনওসি) দেয়া হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা নো অবজেকশন সার্টিফিকেট দিয়েছি। তারা চাইলে এখন ভ্যাকসিন আনতে পারবে।

এর আগে দুপুরে এনওসি চেয়ে আবেদন করে বেক্সিমকো।

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা ব্যবহারের তালিকায় প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছে একের পর এক দেশের নাম। অধীর অপেক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশের মানুষও। করোনার ভ্যাকসিন পাওয়া নিয়ে দিনভর শঙ্কার মধ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা বাংলাদেশে জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর।

সোমবার রাতে এ টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়। এই অনুমোদনের ফলে করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে করোনা ভ্যাকসিনের টিকা দেশে আনতে কোনো বাধা থাকছে না। বাংলাদেশ আগামী মাসের শুরুতে যে ৫০ লাখ ডোজ টিকা পাবে বলে আশা করা হচ্ছে সেটি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন। প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ হিসাবে পুরো তিন কোটি টিকার জন্য অগ্রিম হিসেবে ৬শ কোটি টাকা সিরামের অ্যাকাউন্টে রোববার জমা দেওয়ার কথা জানিয়েছে সরকার।

এদিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, রফতানি শুরুর আগে আগামী দুই মাস ভারতের চাহিদা পূরণ করতেই জোর দেবে সিরাম। এতে বাংলাদেশের টিকা পাওয়া বিলম্বিত হতে পারে বলে শঙ্কা তৈরি হয়। তবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক মনে করছেন, করোনাভাইরাসের টিকা রফতানির বিষয়ে ভারতের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে করা চুক্তিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না। আর মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা সচিব মো. আবদুল মান্নান বলেছেন, যে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হচ্ছে, তা দেশটির অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে হওয়া চুক্তি। বাংলাদেশ যে চুক্তি করেছে সেটা সরকারের সঙ্গে সরকারের। এটা আন্তর্জাতিক চুক্তি। তাই এটা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে না। অন্যদিকে সিরাম ইনস্টিটিউট তাদের তৈরি টিকা এখন ভারতের বাইরে রফতানি করতে পারবে না এমন খবর প্রকাশের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। ভারত যদি নিষেধাজ্ঞা দেয়ও তা হলেও তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের যে উষ্ণ সম্পর্ক, তাতে আমাদের টিকা পেতে কোনো সমস্যা হবে না বলে আশা করি।

ভারত সরকারের ওষুধ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা রোববার কোভিশিল্ডের জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ায় সেখানে নাগরিকদের টিকাদান শুরুর পথ তৈরি হয়। সেই খবরে বাংলাদেশেও দ্রুত টিকা পাওয়ার আশা জোরালো হয়ে ওঠে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার তিন কোটি ডোজ কিনতে গত বছরের ৫ নভেম্বর সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে টিকার ৫০ লাখ ডোজ পাঠাবে সিরাম। আর ভারত থেকে টিকা এনে বাংলাদেশে সরবরাহের জন্য আগস্টে সিরামের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় দেশের ওষুধ খাতের শীর্ষ কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। চুক্তি অনুযায়ী বেক্সিমকো বাংলাদেশে সিরামের উৎপাদিত ভ্যাকসিনের ‘এক্সক্লুসিভ ডিস্ট্রিবিউটর’।

ভারতে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিরাম ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, তাদের টিকা রফতানির ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। সিরাম ইনস্টিটিউটের জনসংযোগ কর্মকর্তা মায়াঙ্ক সেন দিল্লিতে বিবিসিকে জানান, টিকা রফতানিতে নিষেধাজ্ঞার যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা পুরোপুরি সঠিক নয়। কারণ তাদের টিকা রফতানির ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে কোম্পানিটি এখন অন্য দেশে টিকা রফতানির অনুমতি পাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে, যা পেতে কয়েক মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তবে রফতানি শুরুর আগেই ভারত সরকারকে ১০ কোটি টিকা দেওয়ার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তারা রফতানি করতে পারবে না, যেহেতু তাদের রফতানির অনুমতি নেই।

চুক্তিতে নির্ধারিত সময়েই বাংলাদেশ টিকা পাওয়ার আশা প্রকাশ করে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের চিফ অপারেটিং অফিসার রাব্বুর রেজা বলেন, টিকা পাওয়া নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। আমাদের সঙ্গে তাদের সিরাম ইনস্টিটিউটের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। আজও বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছে। তারা আমাদের আশ^স্ত করেছেন। আমরা নিশ্চিত, আমাদের সঙ্গে যেভাবে চুক্তি হয়েছে সে অনুযায়ী, সে সময়েই আমরা ভারত থেকে টিকা পাব। এক প্রশ্নের জবাবে রাব্বুর রেজা বলেন, সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে আমাদের চুক্তি অনুযায়ী টিকা বাংলাদেশে অনুমোদন পাওয়ার পর এক মাসের মধ্যে আমরা প্রথম লটের টিকা পাব। তিনি জানান, ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কোভিশিল্ডের অনুমোদনের জন্য বৃহস্পতিবারই তারা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে কাগজপত্র জমা দিয়েছেন।

টিকা দেশে আনা প্রসঙ্গে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাজমুল হাসান পাপন জানান, চুক্তিতে পরিষ্কার বলা আছে, আমাদের দেশে অ্যাপ্রুভাল দেওয়ার এক মাসের মধ্যে তাদের (সিরাম) টিকা দিতে হবে। এটা একটা আন্তর্জাতিক চুক্তি। নাজমুল হাসান বলেন, এখানে জিটুজির (বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারতের সরকার) কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

চুক্তি যেহেতু হয়ে গেছে, এটাতে কোনো সমস্যা হওয়ার কারণ নেই। এটা নিয়ে আজ সিরামের সঙ্গেও কথা হয়েছে। তারা এমন কোনো ইঙ্গিত দেয়নি যে, করোনার টিকা আসতে দেরি হতে পারে। সরকার যদি নিয়মকানুন মেনে দিয়ে দেয়, এক মাসের মধ্যে টিকা আসবে। এর নিয়ন্ত্রণের দিকটা বাংলাদেশ সরকারের ওপর নির্ভর করছে। তিনি জানান, ইতোমধ্যে করোনার টিকা পরিবহনের জন্য সাতটি গাড়ি আমদানি করা হয়েছে। এ ছাড়া বিশেষায়িত কুল বাক্স আনা হবে। ঢাকায় একটি কেন্দ্রীয় গুদাম তৈরি করা হয়েছে। এটা বাণিজ্যিক চুক্তি। আমরা শুধু সরকারকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক অনেকদিন থেকে বলে আসছেন, ভারত অনুমোদন দিয়ে দেওয়ায় জানুয়ারির মধ্যেই বাংলাদেশ অক্সফোর্ডের টিকার প্রথম চালান পেয়ে যাবে। কিন্তু সিরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী আদর পুনাওয়ালার বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বলা হয়, আগ্রহী দেশগুলোতে রফতানি শুরুর আগে আগামী দুই মাস তারা স্থানীয় চাহিদা পূরণ করতেই জোর দেবে। পুনাওয়ালা বলেন, ভারতে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলো যাতে প্রথমে টিকা পায়, সরকার সেটাই নিশ্চিত করতে চাইছে এবং এ সিদ্ধান্তের প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। তার ওই বক্তব্যের পর বাংলাদেশ সঠিক সময়ে টিকা পাওয়া নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।

সোমবার সচিবালয়ে করোনাভাইরাস টিকা সংক্রান্ত এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য সচিব এ বিষয়ে কথা বলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এ বিষয় নিয়ে বেক্সিমকো, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ভারতের মিশনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তারা আশ^স্ত করেছেন, আমাদের সঙ্গে হওয়া চুক্তি ব্যাহত হবে না। কোনো সমস্যা হবে না, আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।

সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মান্নান বলেন, টিকার ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যেহেতু জিটুজি চুক্তি হয়েছে সেহেতু বাংলাদেশ যথাসময়ে টিকা পেতে কোনো সমস্যা হবে না। ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনারের সঙ্গে এইমাত্র কথা হয়েছে আমার। তিনি আমাকে জানিয়েছেন, আমরা যে চুক্তি করেছি, সেখানে আর্থিক লেনদেন হয়েছে দুই সরকারের মধ্যে। ভারত যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেটা তাদের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে, আমাদের ব্যাপারে না। হাইকমিশন থেকে এটা পরিষ্কার করে দিয়েছে। তিনি বলেন, সব দেশের জন্য তারা এই বার্তা দিয়েছে যে, আগে ভারতের জন্য হবে, তারপরে অন্য দেশে যাবে। তবে আমরা আশ^স্ত যে, এটা কোনো সমস্যা হবে না, সমাধান হয়ে যাবে। তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পাওয়ার পর জানাবে, আমরা কবে পাব।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়টি সাংবাদিকদের কাছ থেকেই জানতে পারি। এরপর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা জানিয়েছে তারা এ ব্যাপারে কিছু জানে না। কী হয়েছে তারা জানার চেষ্টা করছে। আমরা এ নিয়ে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছি। বাংলাদেশ ভারত থেকে যথাসময়ে ভ্যাকসিন পাবে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়েছিল ৮ মার্চ। তা ৫ লাখ পেরিয়ে যায় ২০ ডিসেম্বর। এর মধ্যে ২ জুলাই ৪ হাজার ১৯ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়, যা এক দিনের সর্বোচ্চ শনাক্ত। প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। ২৯ ডিসেম্বর তা সাড়ে সাত হাজার ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে ৩০ জুন এক দিনেই ৬৪ জনের মৃত্যুর খবর জানানো হয়, যা এক দিনের সর্বোচ্চ মৃত্যু।

সূত্র. দৈনিক সময়ের আলো