সীতাকুণ্ডে সুখ-স্বাচ্ছন্দময় পর্যটন উন্নয়নে আলো ছড়াচ্ছে ইপসা

নিজস্ব সংবাদদাতা, সীতাকুণ্ড ।।

সীতাকুণ্ডে সুখ-স্বাচ্ছন্দময় পর্যটন উন্নয়নে আলো ছড়াচ্ছে ইপসা
শ্রী শ্রী চন্দ্রনাধাম মন্দিরে উঠতে শম্বুনাথ বাড়ির পড়েই ভ্রমণপিপাসুদের চোখে পড়বে পাকা সড়কটি — ছবি মোহছেনা মিনা।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেশের ১৬ কোটি ৮ লক্ষ মানুষের মধ্যে তরুণের সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি ৩৫ লক্ষ। ২০১৮ সালে স্থানীয় প্রায় ৭০ লাখ মানুষ দেশের বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় পরিদর্শনে যায়। যার মধ্যে ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষ সীতাকুণ্ডে বেড়াতে আসে। শিবচতুর্দশী মেলাকে কেন্দ্র করে ৩-৪ লাখ মানুষ চন্দ্রনাথ পাহাড় পরিদর্শনে আসে।

ফলে প্রাকৃতিক সৌর্ন্দযের লীলাভূমি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ইকো-ট্যুরিজম বা পরিবেশবান্ধব পর্যটন উন্নয়নের পর্যটকদের আকর্ষণ করার চেষ্টা আরোও জোরদার হচ্ছে। এসব পর্যটক কেন্দ্রের আশে-পাশের ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা এগিয়ে আসছে এই পর্যটন শিল্পকে কিভাবে সীতাকুণ্ডে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। পরিবেশের কোন রুপ ক্ষতি না করে এখন স্থানীয়রা ঝুঁকছে পর্যটন শিল্পের দিকে।

স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন সংস্থা (ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন) ইপসা- পেইস ইকো-ট্যুরিজম প্রজেক্ট-এর ফোকাল পারসন জিমি রয় বলেন, পর্যটকেরা যখন কোনো পর্যটন এলাকায় এসে ব্যয় করে তখন ঐ পর্যটন এলাকার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়৷ তবে পর্যটকদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টির দিকেও বিশেষ নজর দিতে হয়৷ তারা কী ধরণের খাবার খেতে ভালোবাসে, তাদের পছন্দ-অপছন্দ কীরকম, পর্যটক হিসেবে তাদের এই সব চাহিদা সম্পর্কে সচেতন হলে তার ফল হয় ইতিবাচক।

গোটা সীতাকুণ্ডে দিন দিন পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ছে৷ ফলে সীতাকুণ্ডে নেমে কোন টুরিস্ট গাইড, ফটোগ্রাফার এবং বিউটিশিয়ানকে সান্নিধ্যে পাওয়া এসব আর বিরল নয়।

একটি হিসেব অনুযায়ী সীতাকুণ্ডে পর্যটকদের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়ছে। ২০১৮ সালে সীতাকুণ্ডে পর্যটকদের ভ্রমণের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০-১২ লাখ, ২০২০ সাল নাগাদ সেই সংখ্যা দাঁড়াবে ১৫ লাখে।

স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন সংস্থা (ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন) ইপসা- পেইস ইকোটুরিজম প্রজেক্ট-সমীক্ষা চালিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।

ধারণা করা হয়, যে দেশের জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ বয়সে তরুণ। এদের বেশিরভাগই শিক্ষিত। ফলে পর্যটক হিসেবে এদের আকর্ষণ করার চেষ্টা চলছে।

জিমি রয় বলেন, সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়, ভাটিয়ারীর প্রাকৃতিক লেক, গুলিয়াখালীর সী-বিচ, কাট্টলী সী-বিচের মতো নয়নাভিরাম স্পটগুলো পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

ঈদের ছুটিতে এখানে বেড়াতে আসেন অসংখ্য পর্যটক। যেমন ঢাকা মিরপুর থেকে এক নবদম্পতি বিয়ের পর সময় কাটাতে সীতাকুণ্ডে এসে খুবই সন্তুষ্ট৷ তাদের মতে, চট্টগ্রাম শহর থেকে সীতাকুণ্ডে দূরত্ব খুব বেশি নয়। অন্যান্য পর্যটন এলাকার তুলনায় ব্যয় হয় অনেক কম। এখানে সামুদ্রিক মাছসহ স্থানীয় হোটেল গুলোতে মানসম্মত খাবার পাওয়াও সহজ৷ স্থানীয় জমির সবজি, চাল ও সামুদ্রিক মাছের যোগান থাকায় অনেক পরিবার সীতাকুণ্ডে বেড়াতে এসে বিশেষ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন৷

‌ভিজিট বাংলাদেশ’ স্লোগানে শুরু হয়েছিল পর্যটন বর্ষ-২০১৬। বাংলাদেশ ও দেশের বাইরের ভ্রমণপিপাসুদের স্বাগত জানিয়ে চলমান রয়েছে ইপসা পরিচালিত কমিউনিটি রেডিও ‌রেডিও সাগর গিরি’র বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণা। রেডিও সাগর গিরি’র প্রোগ্রাম প্রোডিউসার মোহছেনা মিনা বলেন, পরিবেশের কোনোরুপ ক্ষতি না করে একেবারে কাছাকাছি চলে গিয়ে যাতে ভ্রমণপিপাসুরা ঘুরে বেড়াতে পারে সে প্রচারণাই করে থাকে রেডিও সাগর গিরি।

কথা হয় রানী দেবীর সঙ্গে। সে একজন নারী বিউটিশান। নিয়মিত সে তার পার্লারে নারী পর্যটকদের রুপচর্চার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। দূর-দুরান্ত থেকে আসা অনেক নারী পর্যটকই চায় একটি বিউটি পার্লারে গিয়ে রুপচর্চার কাজটি সেরে নিতে। সেই জায়গাটিও কিন্তু এখন সীতাকুণ্ডে হাতের নাগালেই পাওয়া যাচ্ছে।

পড়াশুনার পাশাপাশি আয়ের উৎস হচ্ছে ছবি তোলা। পর্যটকদের অপেক্ষায় দুই তরুণ ফটোগ্রাফার। — ছবি মোহছেনা মিনা।

ইতোমধ্যে পর্যটকদের ছবি তুলে দিয়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন তরুন ফটোগ্রাফার জীবন সিনহা। মোস্তফা হাকিম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পড়াশুনার পাশাপাশি নিয়মিতই এখানে ছবি তুলে পর্যটকদের আকর্ষণ করছেন। এই তরুণ ফটোগ্রাফার বলেন আমার বাড়ি চন্দ্রনাথের কাছেই। একদিন আমি ইপসার আয়োজনে ইকো-ট্যুরিজম ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করি। সেখানে কিভাবে ফটোগ্রাফির মাধ্যমে আয় করা যায় সে বিষয়ে ধারণা লাভ করি। এবং ইপসা আমাকেসহ চারজনকে বেসিক ফটোগ্রাফি কোর্স করার সুযোগ করে দেয়। এবং আমরা সম্প্রতি কোর্স সম্পন্ন করে এসেছি এবং আমার মতো আরোও অনেকে পড়াশুনার পাশাপাশি অর্থ উপার্জন করছে ছবি তুলে।

পর্যটকদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টি মাথায় রেখে এখানে রয়েছে ‘হোম স্টে সার্ভিস’। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের নিচে ভূইয়া পাড়া, মধ্যম মহাদেবপুরে এটি অবস্থিত। স্থানীয়দের কাছে এটির পরিচিত নাম হচ্ছে ‘হুমায়ুন হোম স্টে সার্ভিস’। সুন্দর মনোরোম পরিবেশে ‘হুমায়ুন হোম স্টে’ সার্ভিসটি উপভোগ করতে আপনাকে খরচ করতে হবে মাত্র ১৫০০ টাকা। সার্ভিসটি চালু করতে সহযোগিতা করেছে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এবং বাস্তবায়ন করেছে ইপসা ।

নারী ও পুরুষ পর্যটকদের জন্য তৈরি করা হয়েছে একটি আধুনিক টয়লেট ও বাথরুম সার্ভিস।– ছবি মোহছেনা মিনা

চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠতেউপরে ইসমাইল হোটেলের পাশে নারী ও পুরুষ পর্যটকদের জন্য তৈরি করা হয়েছে একটি আধুনিক টয়লেট ও বাথরুম সার্ভিস। ‘চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সীতাকুণ্ডে ইকো-ট্যুরিজম শিল্পের উন্নয়ন’ শীর্ষক ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এই সার্ভিস প্রোভাইডারের নাম মোঃ ইসমাইল। এটিও পিকেএসএফ’র সহযোগীতায় ইপসা বাস্তবায়ন করেছে।

ইপসার প্রধান নির্বাহী মোঃ আরিফুর রহমান বলেন, সীতাকুণ্ডে রয়েছে পর্যটক আর্কষণের সম্ভাব্য সকল প্রাকৃতিক উপাদান। প্রাকৃতিক সৌর্ন্দযের লালনভূমি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ইকো-ট্যুরিজম বা পরিবেশবান্ধব পর্যটন উন্নয়নের সম্ভাবনা অপরিসীম। পরিকল্পিত টেকসই উন্নয়ন ও স্থানীয় জনগণের সমন্বিত অংশগ্রহণই একমাত্র নিশ্চিত করতে পারে ইকো-ট্যুরিজম বা পরিবেশবান্ধব পর্যটন। এর ফলে যেমন নিশ্চিত হবে পরিবেশের সংরক্ষণ ও স্থানীয় জনগণের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন। সরকার ২০১০ সালে একটি পর্যটন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, সেখানে বহুমাত্রিক পর্যটনের কথা বলা হয়েছে। বহুমাত্রিক পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড। পর্যটনশিল্পের বিকাশের ওপর বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভর করছে। দেশে পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটলে কর্মসংস্থান ঘটবে ও বেকারত্ব দূরীকরণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন হবে এবং স্থানীয় জনগণের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। দারিদ্র্য বিমোচন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নের জন্য সংগঠন ইপসা’র অন্যতম মূলনীতি। সেই মূলনীতিকে লালন করে ইপসা বিগত তিন দশকের অধিক সময় ধরে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম বিভাগে দারিদ্র্য বিমোচন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ, স্থানীয় জনগণের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে উন্নয়ন কর্মসূচি সফলতার সাথে বাস্তবায়ন করে আসছে। পাশাপাশি সমস্ত সীতাকুণ্ড ও মীরসরাই কমিউনিটিভিত্তিক ইকো-ট্যুরিজম বা পরিবেশবান্ধব পর্যটন এর প্রসারে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক পরিকল্পনা। ইপসা বিশ্বাস করে, বাংলাদেশকে সত্যিকারের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে কমিউনিটিভিত্তিক পরিবেশবান্ধব পর্যটনশিল্পকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় আনা খুবই জরুরি।