সীতাকুণ্ডের নারীরা স্বাবলম্বী কেঁচো সার উৎপাদন করে

সীতাকুণ্ডের নারীরা স্বাবলম্বী কেঁচো সার উৎপাদন করে

কেঁচো সার উৎপাদন করে স্বাবলম্বী হচ্ছে সীতাকুন্ড উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে নারীরা। এতে পরিবারে আসছে আর্থিক সচ্ছলতা। জৈব কেঁচো সার ব্যবহারে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি ফসল উৎপাদনও বাড়ছে।  এলাকায় গিয়ে জানা যায়, সীতাকুন্ড উপজেলার মুরাদপুর, নলোয়াপাড়া, সৈয়দপুর, গুলিয়াখালিসহ বিভিন্ন গ্রামে কেঁচো সার উৎপাদন করছে শতাধিক নারী। ঘরের কাজের পাশাপাশি স্বল্প পুঁজি ও কম পরিশ্রমে কেঁচো সার উৎপাদন করা যায়। তাদের একজন সীতাকুন্ড উপজেলার দক্ষিণ মহাদেবপুর এর নলোয়াপাড়া গ্রামের অচিয়ত উল্লাহ এর স্ত্রী মোছাঃ মর্জিনা আক্তার। স্বামী আর তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে তার সংসার। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন কয়েকবছর আগে এবং ছোট দুই ছেলেমেয়েকে পড়াশুনা করাছেন। মেয়েকে পড়াশুনার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন সেলাই কাজে। গত দুই বছর যাবত কেঁচু সার উৎপাদন করছেন মোছাঃ মর্জিনা আক্তার। টেলিভিশন এবং পত্রিকাতে কেঁচো সারের উপকারিতা দেখে স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নের জন্য সংগঠন ইপসা থেকে প্রশিক্ষণ আর ঋণ সহযোগীতা নিয়ে শুরু করেন কেঁচো সার উৎপাদন।
সীতাকুন্ডের বেশ কয়েকটি এলাকায় ঘুরে দেখা যায় এখানকার মানুষজন কৃত্রিম সার ব্যবহারে অনেক সচেতন। তারা জানে কৃত্রিম সার ব্যবহার করার কারণে সাময়িকভাবে উপকার পেলেও জমির উবরর্তা হ্রাস পাচ্ছে এবং মাটির গুনাগুন নষ্ট হয়ে যায়। তার জন্যই সীতাকুন্ডের কৃষকরা নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে রাসায়নিক সার ব্যবহারের পরিবর্তে এখন কেঁচো সারের ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছেন। কেঁচো সার উৎপাদনকারী মর্জিনা আক্তার সাথে কথা বললে তিনি বলেন, ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা আর খাওয়া পরা নিয়ে অভাব অনটনে চলতো আমার এই সংসার। কৃষি কাজ করে পরিবারের অভাব-অনটন দূর করে পরিবারে স্বচ্ছলতা আনা সম্ভব ছিলো না স্বামীর পক্ষে। ইপসা থেকে প্রথমে আমি কেঁচো সার নিয়ে কয়েকটা প্রশিক্ষণ নিয়েছি, তারপর আমি তাদের থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করি। শুরুতে ইপসা থেকে আমাকে রিং, চালনি, কেঁচো, মোট কথা সার তৈরী করতে যা যা উপকরন লাগে সব আমি পেয়েছি। গত দুই বছরে নিজের জমিতে তেমন কোন রাসায়নিক সার ব্যবহার করেছি না। নিজের জমিতে এই সার ব্যবহার করি এবং অবশিষ্ট অংশ বিক্রিও করছি। বর্তমানে আমি মাসে প্রায় ৩০০ কেজির মত সার উৎপাদন করছি। প্রতি কেজি সার বিক্রি করছি ১০-১৫ টাকা করে। মাসে বিক্রি হয় পাঁচ হাজার টাকার উপরে। যা বছরে প্রায় ৫০,০০০ হাজার টাকার মত। এই কেঁচো সার নিয়ে রয়েছে আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আমি চাই আমরা এই উৎপাদন আরো বেশি হোক। বেশি হলে আমার বিক্রি বাড়বে। এছাড়াও আমি যেহেতু কেঁচো সার উৎপাদন করে লাভবান হয়েছি সেহেতু আমি এখানকার মানুষদের এই কাজটা করার জন্য উৎসাহ করবো। যাতে তারা রাসায়নিক সার ব্যবহার কম করে এই সার বেশি পরিমানে ব্যবহার করে। সবজি চাষে ব্যবহারে সফলতা এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া সহজ হওয়ায় দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে কেঁচো সার। নারীরাও প্রশিক্ষণ নিয়ে কেঁচো সার উৎপাদন করে অর্থ রোজগার করছেন। মর্জিনা আক্তারের দেখাদেখি অন্য নারীরাও উদ্যোগী হচ্ছেন কেঁচো সার উৎপাদনে। আমরা প্রথমে এই সার উৎপাদন করার জন্য আগ্রহী ছিলাম না। কারণ, এই সার উৎপাদন করার জন্য অনেক জিনিস এর প্রয়োজন হয়, পরিশ্রম বেশি হয়। পরে মর্জিনা আপার কাছ থেকে দেথে মনে হলো, এইটা আসলেই অধিক লাভজনক। নিজে ব্যবহারও করা যায়। বিক্রিও করা যায়।এইভাবে কথা বলছিলেন এলাকার আরেকজন নারী নুরচ্ছাপা। কেঁচো সার একটি পরিবেশ বান্ধব উন্নত প্রকিৃতিক জৈব সার। কেঁচো সার একদিকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক তেমনি মাটির পুষ্টিগুন রক্ষার্থে অধিক মূল্যবান। কেঁচো সার ব্যবহারে মাধ্যমে মাঠির উর্বরতা ও গুনাগুন ফিরেয়ে আনা যায়। ফসল উৎপাদনও অনেক ভালো হয়, তার জন্য সীতাকুন্ডের মানুষদের মধ্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে কেঁচো সারের চাহিদা। সীতাকুন্ডের মানুষদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং এর জনপ্রিয়তা বাড়ানো জন্য কাজ করছে সীতাকুন্ডের উপজেলার কৃষি অধিদপ্তর।কেঁচো সার উৎপাদন করে আমাদের সীতাকুন্ডের নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছে। এতে তাদের পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা আসছে। এছাড়া জৈব কেঁচো সার ব্যবহারে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি ফসল উৎপাদনও বাড়ছে। এই কেঁচো সার উৎপাদন করার জন্য যারা আগ্রহী তাদের আমরা বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। এবং এই সার বেশি পরিমানে ব্যবহার করার জন্য আমরা মানুষদের মধ্যে উৎসাহ করছি এবং ভবিষ্যতে এইটা যাতে ছড়িয়ে যায় সেইভাবে চেষ্টা করছি জানালেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাফাকাত রিয়াদ। কেঁচো স্যার উৎপাদন করার জন্য সীতাকুন্ডের মানুষদের শুরুতে অনাগ্রহ থাকলে বর্তমানে এটির জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মর্জিনা আক্তারের মতই সীতাকুন্ডের নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য কাজ করছে স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নের জন্য সংগঠন ইপসা। দেওয়া হচ্ছে ঋণ সহযোগীতা, প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ। আগ্রহীরা এখান থেকে খুব সহজেই সুবিধাগুলো নিতে পারে এমনটা নিশ্চয়তা দিচ্ছে ইপসা প্রানিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: মো: আবু হানিফ সজিব। তিনি আরো জানান, কেঁচোগুলো হলো একটি বিশেষ ধরণের কেঁচো, এইটা আমাদের দেশের সাধারণ কেঁচোর মত না। এইটার উৎপত্তি অস্ট্রেলিয়াতে। এটি আমাদের যথেষ্ট পরিমান মজুদ আছে এবং আমরা সীতাকুন্ডের মধ্যে দশজন খামারিকে বাণিজ্যিকভাবে তৈরী করেছি, তারা নিয়মিত কেঁচো ও সার বিক্রি করছে। আমরা সীতাকুন্ডের ৪টি ইউনিয়নে ৪৩০টি প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করছি। তার মধ্যে আমাদের অধিকাংশ প্রদর্শনীতে কেঁচো এবং কেঁচো সার উৎপাদন হচ্ছে। কেউ যদি কেঁচো সার উৎপাদনে আগ্রহী হয় তাহলে আমার তাদের ক্ষুদ্র ঋণ সহযোগীতা সহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ এবং বিনামূল্যে কিছু উপকরণ দিচ্ছি।