যেভাবে ধ্বংস ডেকে আনে সুদ

যেভাবে ধ্বংস ডেকে আনে সুদ

মাওলানা আমিরুল ইসলাম ।।

সুদ ও সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা উন্নত ও বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থার পথে প্রধান অন্তরায় ।  কোরআন ও হাদিসে সুদকে হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে ‘যারা সুদ খায়, কেয়ামতের দিন তারা সেই ব্যক্তির মতো উঠবে, শয়তান যাকে স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দিয়েছে। এটা এ জন্য হবে যে, তারা বলেছিল ‘ব্যবসাও তো সুদেরই মতো’ অথচ আল্লাহ বিক্রিকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তির নিকট তার প্রতিপালকের পক্ষ হতে উপদেশ বাণী এসে গেছে, সে যদি সুদি কারবার হতে নিবৃত্ত হয়, তবে অতীতে যা কিছু হয়েছে তা তারই। তার (অভ্যন্তরীণ অবস্থার) ব্যাপার আল্লাহর এখতিয়ারে। আর যে ব্যক্তি পুনরায় সে কাজই করল, তো এরূপ লোক জাহান্নামী হবে।

তারা সেখানেই সর্বদা থাকবে। আল্লাহ সুদকে নির্মূল করেন এবং দান-সদকাকে বর্ধিত করেন। আর আল্লাহ এমন প্রতিটি লোককে অপছন্দ করেন, যে অকৃতজ্ঞ ও পাপিষ্ঠ। হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যদি প্রকৃত মুমিন হয়ে থাক, তবে সুদের যে অংশই কারও কাছে অবশিষ্ট রয়ে গেছে তা ছেড়ে দাও। তবুও যদি তোমরা তা না কর, তবে আল্লাহ ও তার রাসুলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও। আর তোমরা যদি সুদ থেকে তওবা কর, তবে তোমাদের মূল পুঁজি তোমাদের প্রাপ্য। তোমরাও কারও প্রতি জুলুম করবে না এবং তোমাদের প্রতিও জুলুম করা হবে না।’ (সুরা বাকারা : ২৭৫-২৭৯)

পবিত্র কোরআনের এই আয়াতগুলোর মাধ্যমে সুদকে চিরদিনের জন্য হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। সুদের ব্যাপারে নবীজিও অনেক কঠোর বাণী উচ্চারণ করেছেন। হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) সুদ ভক্ষণকারী, সুদ দাতা, সুদ লেনদেনের সাক্ষী ও সুদ কারবারের লেখকের ওপর অভিশাপ বর্ষণ করেছেন।’ (মুসলিম : ১৫৯৮)। সুদের ব্যাপারে এর চেয়েও শক্ত কথা বলেছেন নবীজি।

হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ‘সুদের সত্তর প্রকার গুনাহ রয়েছে, তার ভেতর সবচেয়ে নিম্ন স্তরের গুনাহ হচ্ছে নিজের মায়ের সঙ্গে জিনা করার গুনাহ।’ (ইবনে মাজা : ২২৭৪)। সুদে লিপ্ত ব্যক্তির পরিণাম সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘মেরাজের রাত্রে আমি এমন কিছু লোকদের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের পেট খন্ড খন্ড গর্তের আকৃতিতে ছিল। তার ভেতর সাপ ভর্তি ছিল। বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল। তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে জিবরাইল (আ.) উত্তর দিলেন, এরা সুদখোর।’ (ইবনে মাজা : ২২৭৩)

কোরআন হাদিসের বাণীর পাশাপাশি যুক্তি ও বিবেকও এ কথার সাক্ষী দেবে যে, ব্যক্তি ও সমাজ, চরিত্র ও নীতি, অর্থনীতি ও ব্যবসা নীতি সর্ব দৃষ্টিকোণেই সুদ একটি ক্ষতিকর ও ধ্বংসকারী বিষয়। সুদের কারণেই মানুষের মধ্যে স্বার্থান্ধতা, লোভ, কৃপণতা ও দয়াপরবশহীনতার মতো অসৎ ও নোংরা আচার বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়।

ফলে সামাজিক জীবনের স্বাভাবিকতা ও শান্তি পরিবেশ একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যায়। সুদভিত্তিক ব্যবস্থায় জীবনযাপনকারী ব্যক্তিরা পরস্পরে ক্ষোভ, হিংসা, শত্রুতা ও অনিষ্ট কামনার রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এর প্রেক্ষিতে একে অপরের সাহায্য ও সহযোগিতায় আসার পরিবর্তে নিজের স্বার্থসিদ্ধির চিন্তায় বিভোর থাকে। সুদে নিমজ্জিত ব্যক্তির হৃদয় পাষাণ ও দয়াহীন শুষ্ক হয়ে থাকে। সুদে অর্থ প্রদানকারী ব্যক্তি সর্বদা অবৈধ মুনাফা অর্জনের নেশায় ডুবে থাকে, সে এ কথার ভ্রুক্ষেপ করে না যে, ঋণগ্রহণকারী ব্যক্তি কী পরিমাণ ক্ষতি ও অসুবিধার ভেতরে রয়েছে। মানুষের মর্মান্তিক ও মুমূর্ষ অবস্থার বিষয়টিও তার নিকট নগণ্য হয়ে যায়।

সুদখোরের একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে অধিক মুনাফার প্রতি। ফলে যেখানে বেশি লাভ দেখে সেখানে অর্থ বিনিয়োগ করে। মানুষের জরুরি প্রয়োজনের গুরুত্ব তার কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়ে। এর ফলে দুই ধরনের মৌলিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এক. জরুরি জিনিসপত্রের স্বল্পতা দেখা দেয়। দুই. জিনিসপত্রের দাম বহুগুণ বেড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। তখন অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ বেশি থাকার পরও দুশ্চিন্তা, অশান্তি ও নিরাপত্তাহীন জীবন যাপন করতে হয়। মানুষের চারিত্রিক গুণাবলি, ভালোবাসা, কল্যাণকামিতা ও সহমর্মিতা ইত্যাদি মানুষের ভেতর থেকে বিদায় গ্রহণ করে। এসব গুণাবলি নিঃশেষ হওয়ার পর হৃদ্যতা ও ভ্রাতৃত্বের অনুভ‚তি ধ্বংস হয়ে মানুষের সমাজ পাশবিক সমাজে পরিণত হয়।

সুদের অভিশাপে মানব সমাজ হৃদয়বিদারক ও আত্মঘাতীমূলক পরিস্থিতির শিকার হয়। প্রতিটি মানুষেরই এ কথা ভাবার ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণাকে অবহেলা ও উপেক্ষার দৃষ্টিতে দেখার কী ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে পারে! এবং সুদের শেষফল ইহকালে দারিদ্র্য ও পরকালে কঠিন আজাবের প্রকাশ হলে সেটা ধারণ ও সহ্য করার সক্ষমতা আমাদের আছে কি না? যদি না থাকে, তাহলে সুদি লেনদেন করছি আমরা কোন সাহস ও ক্ষমতাবলে! সুতরাং ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের স্বার্থেই সুদি কারবার থেকে নিজেকে পবিত্র করা চাই। আল্লাহ তাওফিক দান করুন।

লেখক : শিক্ষক, ইমাম আজম ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা