কেন দেরি হচ্ছে বন্যার পানি নামতে- এসএম মিন্টু

কেন দেরি হচ্ছে বন্যার পানি নামতে- এসএম মিন্টু
কেন দেরি হচ্ছে বন্যার পানি নামতে- এসএম মিন্টু

সিলেট-সুনামগঞ্জসহ আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চল স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে । হাওরাঞ্চল হিসেবে পরিচিত এ এলাকাগুলোর বন্যার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে আশপাশের জেলাগুলোতেও। এ ছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চলে দেখা দিয়েছে বন্যার ভয়ানক প্রভাব। একের পর এক অঞ্চল প্লাবিত হয়ে নিম্নাঞ্চলগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।

এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, হাওরের সড়ক, বাঁধ, ব্রিজ ও কালভার্ট নিয়ে। বিশেষ করে সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যার সঙ্গে কিশোরগঞ্জের অল ওয়েদার সড়ক (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) নিয়েও নানা কথা উঠেছে। বন্যার ভয়াবহতার জন্য হাওরের ভেতরে অল ওয়েদার সড়ককেও দায়ী করছেন অনেকেই। তাদের মতে, পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার কারণে এ ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, গত কয়েকদিন ধরে সিলেটের সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলেও প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। সিলেটের পানি আসামের বরাক নদ দিয়ে সুরমা ও কুশিয়ারায় প্রবেশ করে। এ পানি নদ-নদী ও হাওর দিয়ে মেঘনা নদীতে চলে যায়। এখন ব্রহ্মপুত্রের পানি যদি পদ্মা দিয়ে চাঁদপুরে আসতে থাকে এবং একই সঙ্গে সিলেটের পানি যদি মেঘনা দিয়ে চাঁদপুরে আসে, তা হলে বন্যা পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে সিলেটের পানি নামতে দেরি হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ভুল পরিকল্পনা, পানি বের হওয়ার রাস্তা না থাকা, জীব পরিবেশ নদী-হাওরের বাধা এবং নদীতে প্রচুর বালি-পাথর থাকা এবং হাওরে অপরিকল্পিত রাস্তাঘাটের কারণে সিলেট অঞ্চলে বন্যায় ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে হাওরের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবনভূমির মতো নয়। ফলে হাওরের সমান্তরালে সড়ক বা সেতুর মতো অবকাঠামো নির্মাণ করা যেতে পারে। কিন্তু হাওরের ভেতর দিয়ে বড় গাড়ি চলে, এমন বড় রাস্তা নির্মাণ করা হলে হাওরের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এ ধরনের সড়ক, সেতু করা হলে সেগুলো দু-চার বছরের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। এসব সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে হাওরের বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় নেওয়া হয় না।

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদফতরের পরিচালক (কৃষি, পানি ও পরিবেশ), ড. আলী মুহম্মদ ওমর ফারুক সময়ের আলোকে বলেন, যেখানে নদীর চওড়া থাকার কথা সেখানে নেই, যেখানে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকার কথা তাও নেই। এ ছাড়া ব্রিজ বানাতে গিয়ে নদীকে শাসন করা, নদীকে ছোট করা হয়েছে যার কারণে পানি যতটা তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার কথা তত তাড়াতাড়ি যাচ্ছে না বলে এ ধরনের বন্যা দেখা দেয়। তিনি বলেন, হঠাৎ বৃষ্টির কারণে এবং প্রতিবেশী দেশ থেকে পানি আসার কারণে বন্যাটা বেড়ে গেছে। অল্প অল্প করে বৃষ্টি হলে এ সমস্যাটা হতো না।

প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ অল ওয়েদার সড়ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন তেমন কিছু বলা যাবে না। তবে ওইসব হাওর এলাকায় এ নতুন নতুন প্রজেক্ট সম্পর্কে একটি রিসার্চ পরিকল্পনা সরকারের কাছে জমা দিয়েছি। সেটা পাস হলে আমরা বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে বোঝা যাবে। তিনি বলেন, ওই রাস্তাটি হয়েছে উত্তর-দক্ষিণমুখী। ফলে দুই পাশেই পানিপ্রবাহের জায়গা রয়েছে।

বিশাল আকারের রাস্তাটি সঠিক নিয়মে করা হয়েছে কি না- এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুটি নদী ওই হাওর দিয়ে গেছে। সেখান দিয়ে পানি নিষ্কাশনে হয়তো কিছুটা ত্রুটি ছিল। এ ছাড়া ব্রিজগুলো সঠিক নিয়মে হয়েছি কি না- তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কারণ এখনও এ রাস্তাটি নিয়ে গবেষণা চলছে। আমরা সরকারের কাছে যে আবেদন জানিয়েছি, তা ভালোভাবে যাচাই করে বলা যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনার‌্যাবিলিটি স্টাডিজের সাবেক পরিচালক এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরীন সময়ের আলোকে বলেন, হাওর অঞ্চলগুলোর প্রাকৃতিক পরিবেশ বাঁধ তৈরির মতো নয়। যেহেতু আগের মতো পানি ধরে রাখার প্রাকৃতিক পরিবেশ এখন আর নেই, তাই কোথাও কোথাও বাঁধ তৈরির প্রয়োজন হয়। কিন্তু সে বাঁধগুলো যদি ত্রুটিপূর্ণ হয় ও মেরামত না হয় তখনই এ সমস্যাগুলো দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে স্থানীয়দের নিয়ে প্রয়োজনীয় স্থানে বাঁধ নির্মাণ করা হলে ভালো কিছু আশা করা যেতে পারে। এখন যেহেতু মাটি ধরে রাখার মতো গাছপালা নেই, সেক্ষেত্রে সরকার বিকল্প পন্থা হিসেবে বাঁধ তৈরি করছে। আর এগুলো যদি সায়েন্টিফিক নলেজ বেজড হয় যেমন- বাঁধ দিলে আসলেই পানি ঠেকানো যাবে কি না, আবার বাঁধ দিলে পানি বের হওয়ার একটা বাধা সৃষ্টি হবে কি না- সেটা মাথায় রেখে কাজ করা উচিত। এক্ষেত্রে খুব টেকসই কাঠামো নির্মাণ না হলে ভালো কিছু আশা করা যায় না।

অল ওয়েদার সড়ক সম্পর্কে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমার ভালো জানা নেই। তবে আগেরগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ভুল পরিকল্পনা, পানি বের হয়ে যাওয়ার রাস্তা না থাকার কারণে বাধগুলো নষ্ট হয়েছে। আর আমাদের দেশের বৃষ্টিপাতের চেয়ে পাশের দেশের বৃষ্টিপাতে বেশি সমস্যা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাঁধ নির্মাণ করলেও কাজ তেমন কিছু হবে না। কারণ ভৌগোলিকভাবে আমরা নিম্ন ভূমিতে থাকা দেশ। তাই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে কাজ করতে না পারলে সমস্যা থেকেই যাবে। ওইখানে হিমালয়ের বরফ গলে যাচ্ছে, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হচ্ছে, তাতে আমরা ভেসে যাচ্ছি। তাদের পানি আমাদের দিকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তাদের পরিকল্পনায় তো বিকল্প রাস্তা থাকতে হবে, কিন্তু সেটা নেই।

পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক সময়ের আলোকে বলেন, সিলেট অঞ্চলের নদীতে প্রচুর বালি ও পাথর আসে। তাই ড্রেজিং করার কয়েক দিন পরই দেখা যায় ফের ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

কয়েকটি কারণে এবার সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা। এগুলো হচ্ছে নদীর নাব্য সঙ্কট, হাওরে অপরিকল্পিত বাঁধ ও সøুইসগেটসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, হাওর বিলঝিল ভরাট, নির্বিচারে পাহাড়-টিলা কাটা। প্রতিবছর উজান থেকে পানির সঙ্গে পলি আর পাথর নেমে এসে আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর বাংলাদেশ অংশের তলদেশ ভরাট করে ফেলে। এতে নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতা কমে যায়। তখন এসব নদীতে বেশি পানি এলে তা উপচে আশপাশের এলাকা ভাসিয়ে ফেলে।

পানি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত বলছেন, ‘অল ওয়েদার’ সড়কের সঙ্গে সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যার কোনো সম্পর্ক নেই। মেঘালয় থেকে বৃষ্টির পানি নামছে। গত চার দিনে চেরাপুঞ্জিতে আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। সেই সঙ্গে সুনামগঞ্জে প্রায় ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। রাজধানী ঢাকায় যদি ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় তা হলে গুলশান আর বারিধারা ছাড়া সব ডুবে যাবে। তা হলে কী পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে এটা বোঝা উচিত।

অল ওয়েদার সড়ক বন্যার জন্য দায়ী কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, একটা সড়ক কখনও বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ভয়ঙ্কর বৃষ্টি হয়েছে। আমরা যেহেতু নিচু অবস্থানে আছি সেক্ষেত্রে এটা একটা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যে পানি এ অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হবে। এটা কেউ ঠেকাতে পারবে না।

তিনি আরও বলেন, কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে তা ঠিক নয়। কারণ এ রাস্তাটি উত্তর-দক্ষিণমুখী। সিলেট ও সুনামগঞ্জ দিয়ে যেভাবে পানি বেড়েছে, তাতে এ সংযোগ সড়কটির কারণে এখনও কোনো ক্ষতির প্রমাণ মেলেনি। তিনি আরও বলেন, হাওরাঞ্চলের মানুষের জন্য এখন খাদ্য বা ত্রাণ নিশ্চিত করা জরুরি।

এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা সময়ের আলোকে বলেন, সিলেটে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। এটা আমাদের ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। সিলেট শহর পুরোটাই হয়তো ধ্বংস হয়ে যেতে পারত। কিংবা ভূমিকম্প হয়ে যেতে পারত। তিনি বলেন, মেডিকেল কলেজ কেন বন্ধ থাকল। বিমানবন্দর, রেলস্টেশন কেন বন্ধ করা হলো। এগুলো আগে থেকেই সুপরিকল্পিতভাবে করা উচিত ছিল। মে মাসে যখন বন্যা হলো, বিকল্প হিসেবে কী ব্যবস্থা রাখা হয়েছে? পানি নামার পর যেন আর কোনো পানি না উঠতে পারে তার জন্য কেন মাটির বাঁধ দেওয়া হলো না। আবার এ বৃষ্টি হলো। এবার তো পুরো গাঁ ডুবে যাওয়ার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এখন যে বাঁধ দিয়েছে, সেই বাঁধতো আগেও দিতে পারত। বড় ধরনের দুর্যোগ হতেই পারে। তার মোকাবিলার করার জন্য কী করা হয়েছে? ইমারজেন্সি ব্যবস্থা যেমন- বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, মেডিকেল রক্ষার জন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়েছিল কি না- সেটাই প্রশ্ন।

বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে অল ওয়েদার সড়কের কারণে সিলেট অঞ্চলে বিপর্যয়- এ প্রসঙ্গে এই দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রথমত হাওরে বাঁধের জন্য পানি ওঠেনি। অল্প সময়ের মধ্যে এত পানি উঠেছে, পানিগুলো কোথা যাবে, কীভাবে যাবে সবার আগে এটা একটা স্টাডি দরকার।

তিনি বলেন, বাঁধের পাশাপাশি রাস্তাও হয়েছে। পানি আটকে গেছে, ওখানে পানি নিষ্কাশনের জন্য রাস্তাগুলো খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেছেন, রাস্তা ভেঙে দিতে। শুধু একটা ইস্যু নিয়ে এগোলে হবে না। কারণ অনেক ঘটনা আছে একসঙ্গে জড়িত। সেটা আমাদের স্টাডি না করে বলা সম্ভব নয়। এটার সঙ্গে মানুষও দায়ী।

উল্লেখ্য, অল ওয়েদার সড়কটি ২৯.৭৩ কিলোমিটারের দীর্ঘ। প্রায় ৮৭৪.০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এ সড়ক নির্মিত হয়। কিশোরগঞ্জের সড়ক ও জনপথ বিভাগের তথ্য মতে, ২৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এ অল ওয়েদার সড়কে ৫৯০.৪৭ মিটার দীর্ঘ তিনটি পিসিগার্ডার, ১৯০ মিটার দীর্ঘ ৬২টি আরসিসি বক্স কালভার্ট, ২৬৯.৬৮ মিটার দীর্ঘ ১১টি আরসিসি গার্ডার ব্রিজ রয়েছে। -সময়ের আলো

খালেদ /পোস্টকার্ড ;