আমাজনের অগ্নিকাণ্ড কেন এত উদ্বেগের বিষয় ?

নিহা ।। আমাজনের রেনফরেস্টের আগুন দেশ নির্বিশেষে পরিবেশবিদ ও সরকারের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। মূলত কৃষকদের কৃষিজমি সাফ করতে গিয়েই এ আগুনের সূচনা। এই আগুন এবার ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের নীতিমালা ও পরিবেশবিরোধী ভূমিকাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে।

আমাজনের অগ্নিকাণ্ড ঘটছে কোথায়?

আমাজনের রেনফরেস্ট থেকে শুরু হয়ে এ আগুন উত্তরের জনাকীর্ণ এলাকা যথা রোন্ডোনিয়া ও একরের রাজ্যগুলির উপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। গোটা এলাকা ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছে, সূর্যালোক এসে পৌঁছচ্ছে না। আটলান্টিক সাগরের উপকূলে এবং সাও পাওলো জুড়ে বিকট গন্ধ ও শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

ব্রাজিলের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্চ (আইএনপিই) জানিয়েছে ২০১৩ সলে থেকে এ এলাকায় বনাঞ্চলের অগ্নিকাণ্ড প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে, এবং গত বছর এই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ৮৪ শতাংশ। শুধু এ বছরেই ৭২, ৮৪৩টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে বলে সংস্থা জানিয়েছে। গত কয়েকদিনে ৯,৫০০-র বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে বলেও জানিয়েছে তারা।

আমাজনের আগুন শুরু হল কী করে?

সাপ্তাহিক ব্রাজিল ডি ফেটো পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বোলসোনারোর পরিবেশ বিরোধী বক্তব্যের ফলে কৃষকরা সাহস পেয়েছেন। তাঁরা রেনফরেস্টের বুক চিরে যাওয়া হাইওয়ের উপর অগ্নিদিবস পালন করেছেন। ওই প্রতিবেদনে স্থানীয় এক সংবাদপত্রকে উদ্ধৃত করে জানানো হয়েছে, স্থানীয় কৃষকরা কয়েকদিন আগে রেনফরেস্টের একটি অংশে আগুন লাগিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ওই প্রতিবেদনে এক কৃষককে উদ্ধৃত করা হয়েছে। “আমরা প্রেসিডেন্টকে দেখাতে চাই যে আমরা কাজ চাই। আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট করে জানানোর জন্য আমরা আগুন লাগিয়েছি।”

আইএনপিই-র এক গবেষক আলবার্তো সেৎজার এ বছরই সংবাদসংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, এ এলাকার আবহাওয়া অতি শুষ্ক নয়। “শুষ্ক আবহাওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়াতে পারে বটে, কিন্তু আগুন প্রথম লাগায় মানুষ, হয় ইচ্ছাকৃতভাবে নয়ত দুর্ঘটনাবশত।”

আমাজনের আগুন এত বিশাল যে তা মহাশূন্য থেকেও দেখা যাচ্ছে। নাসা গত ১১ অগাস্ট যে ছবি প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে আগুন ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং  জুলাই এবং অগাস্ট মাসে অগ্নিকাণ্ড বৃদ্ধি চিহ্নিত করেছে উপগ্রহ।

আমাজনের আগুন কেন চিন্তার বিষয়?

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ২০ শতাংশ অক্সিজেন উৎপন্ন হয় আমাজনের রেনফরেস্ট থেকে। এখানে বাস করেন প্রাচীন অধিবাসীরা, যাঁদের জীবন ও বসবাস ক্রমশ বিপন্ন হয়ে পড়ছে, ব্রাজিল সরকার, বিদেশি কর্পোরেট ও স্থানীয় কৃষকদের অধিগ্রহণের জেরে।

২০১৭ সালের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল আমাজন অববাহিকা যে পরিমাণ কার্বন গ্রহণ করে তা অববাহিকার দেশগুলির নির্গত কার্বনের সমান। ফলে বনভূমি পুড়ে গেলে অতিরিক্ত কার্বন নির্গত হবে। কার্লোস নোব্রে এবং চমাস ই লাভজয়, এই দুই বেজ্ঞানিকের গবেষণায় বলা হয়েছে, এর পর অরণ্যবিনাশ করা হলে আমাজন পৃথিবীর বৃহত্তম রেনফরেস্ট থেকে এক বৃক্ষহীন প্রান্তরে পরিণত হবে, যার ফলে এই অঞ্চলের বাস্তুসংস্থান বদলে যাবে।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে আমাজনের রেনফরেস্ট শুধু ওই এলাকার জলচক্রকেই প্রভাবিত করে না, সারা পৃথিবীর জলচক্রকেও প্রভাবিত করে। আমাজনের যে বৃষ্টি উৎপাদিত হয় তা ওই গোটা এলাকা পরিক্রমা করে, এমনকি পৌঁছে যায় আম্দিজ পর্বতমালাতেও। আটলান্টিকের আর্দ্রতা রেনফরেস্টের উপর পড়ে এবং তা ফের বায়ুমণ্ডলে বাষ্পীভূত হয়। রিপোর্টে বলা হয়েছে, আমাজনের রেনফরেস্টে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়, তার অন্তত অর্ধেক সে নিজেই উৎপাদন করতে পারে।

ব্রাজিলের আইনে কী ধরনের পরিবেশগত সুরক্ষার কথা রয়েছে, তাতে সাম্প্রতিক বদলই বা কী?

১৯৬৫ সালের ব্রাজিলের অরণ্য বিধির আওতায় কৃষকরা আমাজনের জমি কিনতে পারেন কিন্তু চাষ করতে পারেন তার ২০ শতাংশ এলাকায়। ১৯৮৮ সালে সামরিক একনায়কতন্ত্র ধসে পড়ার পর নতুন সংবিধানে এলাকার জমির আইনি মালিকানা দেওয়া হয়েছে এলাকার আদিম বাসিন্দাদের। তাঁরা তাঁদের জমির উন্নয়ন প্রত্যাখ্যানের অধিকারী। ২০১২ সালে অরণ্যবিধি সংশোধন করা হয়। এই সংশোধনীতে নষ্ট করা অরণ্যের যতটা আগে ফেরত দিতে হত, তার পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়। বেআইনি বাবে অরণ্যনাশের জন্য শাস্তির পরিমাণও কমিয়ে দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্ট এই বদলগুলিতে সম্মতি দেয়।

২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন বোলসোনারো। নির্বাচনী প্রচারে তিনি বলেছিলেন, তাঁর সরকার আমাজন এলাকা ব্যবসার জন্য খুলে দেবে। আমাজনে বিশাল পরিমাণ সোনা ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ রয়েছে। কৃষিব্যবসা বাড়ানোর জন্য নীতিমালা গ্রহণ ছাড়াও বোলসোনারো আদিম জনজাতিদের জমির সুরক্ষা দেওয়ার বিরোধিতা করেন। জয়ের কয়েক মাস আগে ওয়াশিংটোন পোস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী বোলসোনারো আমাজন অববাহিকায় অবস্থিত দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগানোর প্রস্তাব দেন। জয়ের পর তিনি বলেছিলেন, “কয়েকজন ইন্ডিয়ান সংরক্ষণ করতে চায় বলে ব্রাজিল নিজের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর বসে থাকবে না।”

৬-এর দশক থেকে আমাজনে বিশাল মাপের অরণ্যনাশ শুরু হয়েছে কৃষি, খনিজ উত্তোলন, গবাদি পশুর খামার তৈরি, বিদ্যুৎ প্রকল্পের দৌলতে। ২০১৬ সালের ব্রাজিলের কৃষিবাণিজ্যে যে পণ্য উৎপাদিত হয় তা ছিল ব্রাজিলের মোট রফতানির ৪৬ শতাংশ। পরিবেশ সংরক্ষণবাদীরা অভিযোগ করছেন, সে দেশের শক্তিশালী লবির সাময়িক আর্থিক লাভের জন্য চাপের কাছে নতি স্বীকার করছে ব্রাজিলের সরকার, পিছনে ফেলে দিচ্ছে পরিবেশগত সমস্যাকে।

অগ্নিকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগের বিষয়ে কী প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে ব্রাজিল সরকার?

আইএনপিই-র গবেষণা উড়িয়ে দিয়েছেন বোলসোনারো। বলেছেন বছরের এই সময়টায় কৃষকরা চাষের জমিতে আগুন লাগিয়ে থাকেন। জুলাই মাসে আইএনপিই-র বিজ্ঞানী রিকার্ডো গাভলাওকে বরখাস্ত করেন ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট। রিকার্ডোর অপরাধ ছিল তাঁর প্রকাশিত তথ্যে দেখা গিয়েছিল অরণ্যনাশের পরিমাণ বেড়েছে। বোলসোনারো এই তথ্যকে মিথ্যা বলে অভিহিত করেন এবং বলেন রিপোর্টের সঙ্গে যে ছবি দেখা যাচ্ছে সেগুলি ভুয়ো। আল জাজিরা ইংলিশ বোলসোনারেকে উদ্ধৃত করেছিল। এ ধরনের রিপোর্ট, যা সত্যাবলম্বী নয়, তা ব্রাজিলের ভাবমূর্তির পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে।

 কী বলছে সারা দুনিয়া?

আমাজনে অরণ্যনাশের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অর্থ পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে জার্মানি এবং নরওয়ে। তাদের অভিযোগ অরণ্য বাঁচানোর প্রায় কোনও চেষ্টাই করছে না ব্রাজিল। পরিবেশকর্মীরা এবং বিভিন্ন দেশীয় গোষ্ঠী বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। বোলসোনারোর মন্তব্য এবং নীতির জন্য ব্যাপক সমালোচিতও হতে হচ্ছে তাঁকে।