আইওয়াশ নয় শুদ্ধি অভিযান : গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী

আইওয়াশ নয় শুদ্ধি অভিযান  :  গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী
মেননও বিতর্কিত হবেন নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললে
ভয় শব্দ আমার ডিকশনারিতে নেই
পেঁয়াজ নিয়ে অস্থির হওয়ার কিছু নেই
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সময় নির্ধারিত হয়নি


শুদ্ধি অভিযান কোনো আইওয়াশ নয় বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, যারা দুর্নীতি করেছে তাদেরই ধরা হচ্ছে এবং তাদের শাস্তি কার্যকর হবে। দেশে চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে বিএনপি যখন আইওয়াশ বলছে, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আইওয়াশের ব্যবসা বিএনপি ভালো পারে। মঙ্গলবার বিকালে গণভবনে ন্যাম সম্মেলন বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, মূল যারা দুর্নীতিবাজ তারা তো আগেই শাস্তি পেয়ে গেছে। খালেদা জিয়া পেয়েছেন। তারেক রহমানেরও সাজা হয়েছে। আর আমরা আইওয়াশ কেন করতে যাব? আমি তো আপন-পর দেখিনি। শেখ হাসিনা বলেন, দেশকে দুর্নীতিবাজ বানানো তো বিএনপিই করেছে। মানি লন্ডারিং, ঋণখেলাপি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্ত্রের ঝনঝনানি তো জিয়াউর রহমানই শুরু করেছেন। তারপর এরশাদ, তিনি আরও একধাপ এগিয়ে নিলেন। পরে খালেদা জিয়া এসে তো আরও শুরু করলেন। একদিকে হাওয়া ভবন অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঘুষের লেনদেন।

সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, অপেক্ষা করেন, দেখেন আইওয়াশ না কি, সময়ই বলে দেবে। এখানে কোনো ক্রাইটেরিয়ায় ধরা হচ্ছে না। ধরার পর জানা যাচ্ছে কে কী। যেই অপরাধ করবে তাকেই ধরা হচ্ছে।

নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললে তিনিও বিতর্কিত হবেন মেননকে প্রধানমন্ত্রী
‘গত নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি’ ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননের এমন বক্তব্যের সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন, তিনি ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন না, কারণ তিনি নিজেও ওই ভোটে জয়ী হয়েছেন। তবে মেনন এ ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করায় এখন আর কোনো বক্তব্য থাকতে পারে না বলে জানান ১৪ দলীয় জোটের প্রধান।

মেননকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের এক নেতা হয়তো একটা কথা বলেছেন। তার মনে হয়তো একটা ক্ষোভ, দুঃখ থাকতে পারে। এই নির্বাচনে তিনিও নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললে তিনিও বিতর্কিত হয়ে পড়েন। শেখ হাসিনা বলেন, এ বিষয়ে জোটের মুখপাত্র নাসিম সাহেব আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে আমি বলেছি, এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।

মেনন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ছাত্র আন্দোলন থেকে তিনি (রাশেদ খান মেনন) এমন আচরণ করছেন। স্বাধীনতার আগে বলেছেন, ভোটের বাক্সে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর, পরে ইন্দিরা-মুজিব আমলে স্থলসীমানা চুক্তির সময় বলেছেন বেরুবাড়ি বেঁচে দিল, এমন কথা তিনি অনেক বলেছেন। মেনন প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, কিছু কিছু রাজনীতিবিদ আছেন তারা কথা বলেন। এটা তো আপনাদের জন্য ভালো। কারণ লেখার খোরাক পান। তবে এখন তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

গত নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণ যদি ভোট না দিত, আমাদের পক্ষে না থাকত, তাহলে আমাদের সমর্থন থাকত না। তাদের (বিএনপি) ভোটবিহীন নির্বাচনের বিরুদ্ধে আমরা গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছিলাম। আমাদের জনসমর্থন ছিল। এবারের নির্বাচনের পর জনগণ, ব্যবসায়ীসহ সর্বস্তরের মানুষ আমাদের সমর্থন দিয়েছেন। শুধু আওয়ামী লীগের না, বিএনপির ব্যবসায়ীরাও আমাদের সমর্থন দিয়েছেন। কারণ আমরা সবার কাজ করার সুযোগ করে দিতে পেরেছি।

ভয় শব্দ আমার ডিকশনারিতে নেই
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভয় শব্দটা আমার ডিকশনারিতে নেই। আমাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হলেও আমি কারও কাছ থেকে কোনো ফেবার পাইনি। আমি ছোট থেকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপির যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের সবার বিরুদ্ধেই মামলা আছে। তাদের চেয়ারম্যান দুর্নীতির মামলায় জড়িত হয়ে কারাগারে। দ্বিতীয় ব্যক্তি দুর্নীতির মামলায় দেশান্তরিত। তাদের মুখে এত কথা আসে কীভাবে? কোন সাহসে এই কথা বলে।

পেঁয়াজ প্রসঙ্গ
দেশের অন্যান্য ইস্যুর মধ্যে পেঁয়াজের লাগামহীন দাম বৃদ্ধি আলোচিত খবর। সঙ্গত কারণে আজারবাইজান সফর নিয়ে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা জানতে চান পেঁয়াজের দাম সহনীয় হওয়ার বিষয়ে। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, পেঁয়াজ নিয়ে এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই। কারণ পেঁয়াজ ছাড়াও কিন্তু রান্না করা যায়।

তবে নির্দিষ্ট করে বলতে না পারলেও শেখ হাসিনা জানান, ইতোমধ্যে ৫০ লাখ টন পেঁয়াজ এসেছে। এটা সাময়িক সমস্যা। এই সমস্যা থাকবে না। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি যখন বাইরে ছিলাম তখন শুনলাম পেঁয়াজের দরজা খুলে দেওয়া হলো। শুনেছি ৫০ হাজার টন চলে আসছে। পেঁয়াজ কিন্তু অলরেডি আছে। পত্রিকায়ই তো বলছেন পেঁয়াজ আছে। পেঁয়াজ যারা মজুদ করে রেখেছেন তাদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, যারা মজুদ করে রাখছেন তারা কতদিন রাখতে পারবেন কে জানে। কারণ পেঁয়াজ কিন্তু পচে যায়। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে গিয়ে তাদের কিন্তু লোকসান হতে পারে।

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সময় নির্ধারিত হয়নি
মুজিব বর্ষে পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা যাবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের কোনো সুনির্দিষ্ট সময় বলা যাবে না। পদ্মা সেতুর পুরো প্রক্রিয়াটাই হাইলি টেকনিক্যাল বিষয়। সেতুর নিচের অংশে ট্রেন, ওপরের অংশে গাড়ি চলবে। এটার টেকনোলজিটাই ভিন্ন।

এ ছাড়া নদীর চরিত্রও একটা বড় ব্যাপার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, পদ্মা সবচেয়ে খরস্রোতা নদী। একটা বর্ষার পরেই নদীর চরিত্র বদলায়। পলি পড়ে। গতিপথ পরিবর্তন হয়। এসব কারণে অনেকদিন কাজ বন্ধও রাখতে হয়েছিল। তাই পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করার বিষয়টি অনেক কিছুর ওপরও নির্ভর করে।

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফেরাতে আলোচনা চলছে
মুজিব বর্ষের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব কি না এমন আরেকটি প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমেরিকার সঙ্গে আলোচনা চলছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে চিঠিও দিয়েছিলাম এ ব্যাপারে। নূর আছে কানাডায়, তার ব্যাপারেও কানাডা সরকারের সঙ্গে কথা চলছে। ট্রুডোর (কানাডার প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গেও কথা হয়েছে। তিনি বলেছেনÑ ব্যক্তিগতভাবে তিনিও এ রকম নৃশংস ঘটনার বিচার চান। কিন্তু তাদের দেশের আদালতের কিছু নিয়মের কারণে প্রতিবন্ধকতা আছে। বিশে^র অনেক দেশই এখন মৃত্যুদণ্ড রহিত করেছে। যেহেতু তারা (খুনিরা) মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত, তাই সেই ছুতোয় তারা দেশে না ফেরার কৌশল অবলম্বন করছে।

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দুজনকে আমরা আনতে পেরেছিলাম। হুদাকে আনতে পেরেছি থাইল্যান্ড থেকে। মহিউদ্দিনকে আনতে পেরেছি। যে বিচার করার প্রক্রিয়াই ছিল না, নিষিদ্ধ ছিল, সেই বিচার করতে পেরেছি। যুদ্ধাপরাধীর বিচার জাতির পিতা শুরু করেছিলেন। জিয়াউর রহমান এসে তা থামিয়ে দিল, যারা জেলে ছিল তাদের ছেড়ে দিল, তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দিল। নতুন প্রজন্মকে এসব বিষয়ে অবহিত করতে হবে।

ক্যাসিনোর খবর গণমাধ্যমে আগে আসেনি প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্ন
বাংলাদেশে যেখানে এক হাজারের বেশি সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে, ৩২টির বেশি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল চলছে, বাংলাদেশে এভাবে ক্যাসিনো বসিয়ে জুয়ার আসর চলার খবর কেন কেউ আগে প্রকাশ করল না সেই প্রশ্ন রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সামনে রেখে তিনি বলেন, আপনারা এত খবর রাখেন, তো এই রকম আধুনিক সব যন্ত্রপাতি এসে গেছে, এত কিছু হলো, আপনারা কেউ খবর রাখলেন না? কেউ খবর পেলেন না? কোনোদিন কেউ তো নিউজ করলেন না। কীভাবে হয়?

ক্রিকেটারদের আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন করতে গিয়ে লোকমানের প্রসঙ্গ টেনে একজন সাংবাদিক বলেন, বোর্ডে একজন ‘ক্যাসিনোবাজ’ ঢুকে পড়েছেন, এখনও বহাল তবিয়তে আছেন। বোর্ড ‘প্রপারলি ফাংশন’ করছে কি না সেই প্রশ্ন উঠেছে। উত্তর দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্রিকেটারদের আন্দোলনের সঙ্গে ক্যাসিনো টেনে আনা ঠিক হচ্ছে না। এই ক্যাসিনো খেলার সঙ্গে কে কে জড়িত এটা তো ক্রিকেট বোর্ডের বিষয় না। হয়তো এখানে একজন ছিল। সে রকম তো আপনাদের সাংবাদিক মহলেও যদি খোঁজ করা যায়, অনেককে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। ভবিষ্যতে যদি খুঁজে পাওয়া যায় তো কী করব আমি? সেটাও তো আপনাদের ভাবতে হবে।

শেখ হাসিনা বলেন, ক্যাসিনো কাণ্ডের সেই পরিচালক ধরা পড়েছে। সে বহাল তবিয়তে আছেÑ তাও নয়। তাকে তো ধরা হয়েছে। এটা কিন্তু আপনারা কেউ কখনও নিউজ করেননি। কোনো সাংবাদিক, কোনো সংবাদপত্রে কিন্তু একটা নিউজও আসে নাই যে বাংলাদেশে এ রকম ক্যাসিনো খেলা হয়।

এ সময় সাংবাদিকরা কিছু বলার চেষ্টা করলে তাদের থামিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, নো, নো, কোথাও আমি নিউজ পাইনি, এটা বলে লাভ নাই। ক্যাসিনো সম্পর্কে কেউ কোনো নিউজ দেননি। এটা ধরার দায়িত্ব আমি নিয়েছিলাম। আমি খুঁজে পেয়েছিলাম, আমিই করিয়েছি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমার কাছে যেকোনোভাবে হোক খবর যখন এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, যাকে দিয়ে করলে যথাযথভাবে হবে, তাকে দিয়ে করিয়েছি।

উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ধরব আমরা, আর এ ব্যাপারে আমাদেরই প্রশ্ন করবেন, এটা তো হয় না। এখন আরেকটু সাহায্য করেন, খুঁজে বের করেন কোথায় কী পাওয়া যায়। আমার তো প্রশ্ন, এ রকম একটা ঘটনা বাংলাদেশে ঘটে যাচ্ছে, অথচ কেউ জানে না, সবাই নীরব! হোয়াই? কী কারণে? কারণটা কী?... সে জন্য বললাম, কখন কে কোথায় কী কারণে ধরা পড়ে এটা তো বলা যায় না।

‘ক্রিকেটকে নদীতে নিয়ে যাচ্ছেন কেন?’
বাংলাদেশ-ভারতের টেস্ট ম্যাচ দেখতে ভারত যাবেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে তিস্তা নিয়ে কোনো আলাপ হতে পারে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ক্রিকেটকে নদীতে নিয়ে যাচ্ছেন কেন? এটা প্রধানমন্ত্রীর না, মুখ্যমন্ত্রীর দাওয়াতও না। একজন বাঙালি ছেলে সৌরভ গাঙ্গুলি দাওয়াত দিয়েছে। আমি রাজি হয়েছি। ওখানে আমি ক্রিকেট খেলা দেখতে যাব, সেখানে তিস্তা নিয়ে কেন তিক্ততা তৈরি করব।’
সূত্রঃ  সময়ের আলো